بسم الله الرحمن الرحيم
ভূমিকা :
যে পৌত্তলিকতা ও শিরকের অভিশাপকে উচ্ছেদ করার জন্য মুসলিম জাতির আদিপিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) জীবনবাজি করেছিলেন, আল্লাহর নির্দেশে তিনি ও তাঁর প্রিয়তম পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ) যে পবিত্র কাবাঘরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একত্ববাদ ও তাওহীদের কেন্দ্র রূপে; একদিন সেই পবিত্র কাবাঘরকেই পৌত্তলিকতা ও শিরকের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করেছিল তাদেরই উত্তর প্রজন্ম - মক্কার কুরাইশরা। যে ইব্রাহিম (আঃ) মূর্তি ধ্বংসের অভিযোগে অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন; একদিন তাঁরই বংশধরেরা খোদ কাবা শরীফের ভিতরেই শত শত মূর্তিকে স্থান দিয়ে ক্বাবা শরীফকে শিরকের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। যে কাবাঘর ছিল তাওহীদের কেন্দ্রভূমি, সে কাবাঘরেই এক আল্লাহর ইবাদত ও তাওহীদের কালেমা উচ্চারণকে দেখা হত কাবাঘরের অবমাননা হিসেবে। আল্লাহর ঘরে নামাজ আদায় করার অপরাধে (?) আবু জাহেল রাসুলুল্লাহর ঘারের উপর উটের নাড়ি-ভুড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল। কাবাঘরের চত্বরে কালেমার ঘোষণা দেয়ার কারণে রাসূলের সাহাবীর উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল কুরাইশ সরদারদের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা। এমন অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় পরিবর্তন কী করে সম্ভব হল? সম্ভব হল এ কারণেই যে, নবী ইব্রাহিম (আঃ) যে মিশন নিয়ে, যে মহান আদর্শ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, তাঁর সে জীবন মিশন, তাঁর রেখে যাওয়া মহান আদর্শ এক সময় তাঁর উম্মতদের মধ্য থেকে উঠে গিয়েছিল। স্বয়ং তাঁর বংশধরেরা পর্যন্ত তাঁর মিশন, তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের পথ থেকে বিচ্যূত হয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য এই বিচ্যূতি, এই অধঃপতন একদিনে হয়নি। একটু একটু করে শত শত ও হাজার বছরের বিকৃতি ও বিচ্যূতিই এক সময় অবিশ্বাস্যভাবে মক্কার লোকদেরকে তাদের আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল নবী মূসা (আঃ), ইসা (আঃ) সহ পূর্ববর্তী অন্যান্য নবী-রাসূলদের বেলায়ও। সব ক্ষেত্রেই সেই একই দৃশ্য। আল্লাহর র প্রিয় বান্দা নবী-রাসূলগণ সারা জীবন যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাঁদের অবর্তমানে উম্মতেরা এক সময় তাঁদের অনুসৃত আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলতে শুরু করেছে। বস্তুত এ অধঃপতন তখনই হয়েছিল, যখন নবীর শিক্ষা ও আদর্শ তাদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিদায় নিয়েছিল। নবী-রাসূলগণ পৃথিবীতে কী মিশন নিয়ে এসেছিলেন, কীসের সাধনা ও সংগ্রাম তাঁরা করে গিয়েছিলেন সেই চেতনা তাদের মধ্য থেকে সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য, নবী-রাসূলদের জীবনাদর্শ, তাঁদের সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবি যতদিন জনগণের মধ্যে জাগরুক ছিল ততদিন তারা নবী-রাসূলদের দেখানো পথেই চলেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রত্যেক যুগে, প্রত্যেক নবীর উম্মতের মধ্যে পৌত্তলিকতা জায়গা করে নেয় একটি সাধারণ নিয়মে, আর তা হচ্ছে ব্যক্তি পূজা। আদর্শের চেয়ে যখন ব্যক্তি বড় হয়ে ওঠে তখনি পৌত্তলিকতা জায়গা করে নেয়। যেমন প্রথমে নবীর অবর্তমানে তাঁর আদর্শ, জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি একটা শিথিলতা দেখা দেয়। আর এ স্থান দখল করে ভক্তিবাদ। কারণ ভক্তির জন্য কোন জ্ঞান চর্চার প্রয়োজন হয় না। যে যার ইচ্ছেমত ভক্তি প্রকাশ করতে পারে। এভাবে এক পর্যায়ে আদর্শবাদের চেয়ে ভক্তিবাদ বড় হয়ে ওঠে। নবী পৃথিবীতে কেন ও কী মিশন নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর দাওয়াত কী ছিল, তাঁর সংগ্রাম-সাধানার মূখ্য উদ্দেশ্য কী ছিল, আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নবী-রাসূলগণ কী কী কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন এসব প্রশ্ন ভক্তদের কাছে গৌণ হয়ে যায় আর বড় হয়ে ওঠে তাঁদের মর্যাদার প্রশ্নটি। নবী-রাসূলরা আল্লাহর কী ছিলেন, বন্ধু-বান্ধব ছিলেন নাকি আত্মীয় স্বজন ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ), পুত্র ছিলেন নাকি তিনি স্বয়ং আল্লাহ ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ), এক সময় এসব প্রশ্নই বড় হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে নবী-রাসূলদের জীবনাদর্শ বা সীরাত চর্চার চেয়ে মিলাদ চর্চা - মর্যাদা ও ভক্তিচর্চার পথ ধরেই এক সময় ইহুদীরা অল্লাহকে তাদের নিকটাত্মীয় আর খৃষ্টানরা ঈশাকে (আঃ) অল্লাহর পুত্র বানাতে সক্ষম হয়।
বর্তমান সময়েও আমাদের সমাজে একই সিলসিলা চালু হয়ে গেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) কোন্ মিশন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, তাঁর আহবান কী ছিল, তিনি কোন আদর্শ বাবায়নের জন্য সারা জীবন সংগ্রাম-সাধনা করে গেছেন, কী কারণে স্বেচ্ছায় বিরোধীতার তুফান মোকাবেল করেছিলেন, কুরাইশদের বৈরী প্রচারণা ও হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন, কেন তাঁর পবিত্র শরীর থেকে রক্ত ঝরল, কোন কারণে মহানবী তাঁর নিজের ও সঙ্গী-সাথীদের জান-মাল-ইজ্জত-নিরাপত্তার অপরীসীম ত্যাগ-কোরবানীকে মেনে নিয়েছিলেন এসব প্রশ্ন আজ গৌণ হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে মসজিদে মসজিদে, বাড়িতে বাড়িতে মিলাদ মাহফিল আর ওয়াজ মাহফিলে বয়ান হচ্ছে আল্লাহর রাসূল কত বড় ছিলেন, তাঁর কত শান ছিল, তিনি আসলেই মানুষ ছিলেন নাকি মানুষের সুরতে অতি মানব ছিলেন, তাঁকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ এই বিশ্ব জাহান সৃষ্টি করতেন কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এমনকি আমাদের সমাজে যারা দাওয়াতের আমল করেন, যারা দ্বীনের মেহনতের সময় দেন তাদের কাছেও মহানবীর মিশন স্পষ্ট নয়। অথচ আজ সারা বিশ্বে যে ‘দ্বীনের মেহনতের কাজ’ হচ্ছে, বলা যায় তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। তার প্রমাণ আমরা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা থেকে নিতে পারি। সারা বিশ্ব থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আসেন এই বিশ্ব ইজতেমায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে এখানে। স্বাভাবিকভাবেই, স^াগতিক দেশ হিসেবে এ ইজতেমাকে ঘিরে বাংলাদেশের মুসলিমদের থাকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। রাজধানী ঢাকা ও আশে-পাশের জেলাগুলো সহ সারা দেশ থেকেই ব্যাপকহারে মুসলমানদের আগমন ঘটে থাকে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়। বিশ্ব তাবলীগে জামায়াত এ ইজতেমার আয়োজন করে থাকে। তাবলীগ জামায়াতের প্রধান কাজই হচ্ছে দাওয়াতের মেহনত করা এবং এ মেহনতের জন্য সময় দিতে লোকদের উদ্বুদ্ধ করা।
দায়ী ইলাল্লাহর দায়িত্বকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে হলে মহানবীর মিশনকে সর্বপ্রথম উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ, যে কোন কাজেরই একটি লক্ষ বা উদ্দেশ্য থাকে। আমরা যদি আমাদের কাজের লক্ষ-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন না হই তাহলে এ কাজের যথার্থ হক যেমন আমরা আদায় করতে পারব না, তেমনি এর কোন তাৎপর্য ও গুরুত্বও আমরা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হব। আর দ্বীনের যাবতীয় ব্যাপারে যেহেতু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.)-ই মুমিন জীবনের চূড়ান্ত আদর্শ, সেহেতু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) কীজন্য বা কোন্ মিশন বাস্তবায়নের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন তা জানার প্রয়োজন রয়েছে। কী দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন, তাঁর জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী ছিল, তাঁর আদর্শ কী ছিল, তিনি মানুষকে কোন্ কথার দিকে আহবান জানাতেন, তাঁর দাওয়াতের বক্তব্য ও বিষয়বস্তু কী ছিল এবং মহানবী তাঁর মিশন বাস্তবায়নের জন্য কী কী কর্মসূচী নিয়েছিলেন, কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য তিনি কী কী কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন Ñ এসব জানা না থাকলে দাওয়াতী কাজ নিছক উদ্দেশ্যহীন তৎপরতায় পর্যবশিত হতে বাধ্য এবং লক্ষ-উদ্দেশ্যহীন কাজ থেকে কখনও যথার্থ ফল পাওয়া যেতে পারে না। কারণ লক্ষহীন জীবন মাঝি হীন নৌকার মত।
ইসলামের নামে, রাসূলের আদর্শের নামেও বহু মত ও পথের, বহু দল ও সংগঠনের নানামুখী তৎপরতাও আজ আমাদের সমাজে দেখা যায়। এমনকি ইসলামের নামে বোমাবাজি ও উগ্রবাদও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। অথচ রাসূলের আদর্শ তো একটাই এবং তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আজ ইসলামী দলগুলোর মধ্যকার দলাদলি ও হানাহানি ইসলামপ্রিয় জনতাকে ব্যথিত ও বিব্রত করে তুলছে অথচ আল্লাহর রাসূল ছিলেন ঐক্যের প্রতীক। মহানবীর আদর্শকে যথার্থভাবে গ্রহণ করার কারণেই আউস ও খাজরাজ গোত্র ভুলে গিয়েছিল তাদের চিরদিনের গোত্র-বিবাদ ও শত্রুতার কথা।
মূলত মুসলমানদের মধ্যে আজ এত অনৈক্য ও বিভেদের মূল কারণ হচ্ছে মহানবীর সিরাত, তাঁর মহান জীবনাদর্শ থেকে বিচ্যূতির অনিবার্য পরিণাম। আমরা যদি মহানবীর মিশনকে যথাযথভাবে জানতে পারি, তাঁর জীবনাদর্শের সাথে যদি আমরা নিজেদেরকে মিলিয়ে নিতে পারি, তাহলে তাঁর আনীত ঐশী আদর্শের আলোকে আমরাও পারবো সীসাঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যবদ্ধ হতে, ফিরিয়ে আনতে পারবো আমাদের সোনালী অতীত, ফিরিয়ে আনতে পারবো মুসলিম উম্মাহর সেই শ্রেষ্ঠ জাতির সম্মান, গৌরব ও ঐতিহ্যকে, যে শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। পবিত্র কালামে মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ঘোষণা করেছেন : ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানব জাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদেরকে আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রেখে চলবে।’ -[আলে ইমরান : ১১০]
‘তোমার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে আহবান কর কৌশল আর সদুপদেশের মাধ্যমে। এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে আলোচনা কর। তোমার প্রতিপালক তাঁর পথ থেকে বিচ্যূত লোকদের যেমন জানেন, তেমনি সত্য পথের পথিকদের সম্পর্কেও তিনি বিশেষভাবে অবহিত।’ -[সূরা নাহ্ল : ১২৫]
মহানবীর রিসালাতের প্রথম ও প্রধান মিশন ছিল দাওয়াতের আমল বা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করা। দাওয়াত (دعوت) শব্দের আবিধানিক অর্থ হচ্ছে আহবান করা, আমন্ত্রণ জানানো। আর তাবলীগ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রচার। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় দাওয়াত ও তাবলীগ বলতে বুঝায় মানুষের কল্যাণ কামনায় ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্যকে, এর কল্যাণকর জীবনাদর্শ ও মাহাত্মকে সৎভাবে, শুভাকাক্সিক্ষ ও বন্ধুত্বের মন নিয়ে বিভিন্ন সুন্দর কৌশলের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং প্রচার করা।
দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগ তথা ইসলামের দিকে, ইসলামী মূল্যবোধের দিকে মানুষকে আহবান ও এর প্রচার একটি ফরজি আমল। আল্লাহর দিকে আহবান বা দায়ী ইলাল্লাহর কাজ নামাজ রোজার মতই একটি ফরজ ও মৌলিক ইবাদত। সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ও তার সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন সহ উম্মতে মুসলিমার সকল যুগের বুযুর্গ ব্যক্তিগণ দায়ী ইলাল্লাহর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য সবার আগে মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় প্রতিষ্ঠিত জাহেলী, খোদাবিমুখ, পৌত্তলিক ও ভোগবাদী সমাজের যে প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে বাসা বেঁধে আছে তাকে ঘষে-মেজে পরিষ্কার-পরিশুদ্ধ করে মানুষের মাঝে ইসলামী মন-মানসিকতা তৈরি করতে হলে, মানুষের ভোগবাদী ও দুনিয়াপূজারী মনকে সংযমী ও আল্লাহমুখি করতে হলে ইসলামী আদর্শের, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতে পয়গাম প্রচার এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তো আগে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষেরা যদি সত্যের আহবানকে না জানে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য যদি বুঝতে না পারে, তাহলে তারা জাহেলিয়াতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাবে কীভাবে? একারণেই দায়ী ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর দিকে আহবান ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সহ সমস্ত নবী-রাসূলদের জীবনের অন্যতম প্রধান মিশন। পবিত্র কোরআনে এবং মহানবীর হাদীসে এই মহান মিশন সম্পর্কে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা।
আমরা আগেই বলেছি, দাওয়াত ও তাবলীগ অর্থ আহবান ও প্রচার। মূলত এটি একটি বিরাট ও ব্যাপক বিষয়। এ কাজটিকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে বহুমুখী কর্মসূচী পালন করতে হয়েছিল। আলোচনার সুবিধার জন্য এই বিরাট ও ব্যাপক কাজের আলোচনাকে কয়েকটিকে ভাগ করা যায়।
যেমন :
ক. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা বা তাওহীদের প্রচার ও শিরকের মূলোৎপাটন;
খ. আল্লাহর কালামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া বা কোরআন প্রচার এবং
গ. রিসালাতের ঘোষণা
ঘ. আখেরাতের আদালতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করে তোলা ।
এখন আমরা এ বিষয়গুলোকে আরেকটু বিস্তারিত ভাবে আলোচনার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ক. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা
যেদিন হেরা গুহায় প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদের উপর প্রথম ওহী নাযিল হয়, সেদিন থেকেই শুরু হয় একটি নতুন জীবনবোধের উদ্বোধন। নতুন অথচ চিরন্তন, শাশ্বত ও সনাতন। নতুন বলার একটি কারণ হল, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, সঠিক ধারণা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ পেতে থাকে সেদিন থেকেই। আর এ নতুন জীবনবোধের প্রথম পাঠই হল আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা। সূরা আল আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাযিলের পর আল্লাহ তায়া’লা তাঁর নবীকে গণসংযোগের প্রথম যে নির্দেশ দেন তা ছিল সূরা আল মুদ্দাস্সির-এর প্রথম সাত আয়াত। তাতে বলা হয়-
‘হে চাদর আবৃত্ত শয্যাগ্রহণকারী, ওঠো, সাবধান কর, আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। মলিনতা অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। আর অনুগ্রহ ক'রো না বেশি পাওয়ার আশায়। এবং নিজের রবের জন্য ধৈর্য ধারণ কর।’-[মুদ্দাস্সির : ১-৩]
আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে নবুয়তী দায়িত্ব অর্পন করে সর্ব প্রথম যে নির্দেশ দিচ্ছেন তা হল গণসংযোগের নির্দেশ, মানুষকে সাবধান ও সতর্ক করার নির্দেশ এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণার নির্দেশ। সাথে সাথে একজন দায়ী ইলাল্লাহর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে কী কী গুণাবলী থাকতে হবে সে হেদায়াতও তিনি দিয়ে দিচ্ছেন। বস্তুত যে নতুনত্বের ইঙ্গিত সূরা আলাকে দেয়া হয়েছিল, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বা তাওহীদের ঘোষণা হল সেই নতুন জীবন মিশনের প্রথম পদক্ষেপ। মূলত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য ইসলামী জীবনপদ্ধতির প্রাণস্পন্দন। এই বিশ্বলোকে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব-প্রাধান্য নাই Ñ এ কথাটিই ইসলামের মূলমন্ত্র। ঠিক এ কারণেই ইসলামে ‘আল্লাহ আকবার’ কথাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আযানের শুরুতেই আল্লাহু আকবার ঘোষণাটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে। মুসলমানরা নামাজও শুরু করে আল্লাহু আকবার’ কথাটি উচ্চারণের মাধ্যমে। পশু যবেহ করতে হলেও বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার বলেই তা শুরু করতে হয়। বর্তমানেও তাকবির ধ্বনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যের সবচেয়ে বৈশিষ্টপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত। এসবেরই কারণ হল ইসলামের নবী সর্ব শক্তিমান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের ঘোষণা প্রদানের মধ্য দিয়েই তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন।
মনে রাখা প্রয়োজন, যে যুগ-প্রতিবেশে কোরআন নাযিল শুরু হয়, মক্কার সে সমাজের মানুষগুলো কিন্তু ধর্ম বিরোধী ছিল না। বরং তারা ছিল ধর্মনেতা। পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম বা মোতওয়াল্লি হওয়ার কারণে সমগ্র আরবের মধ্যে কুরাইশরা ছিল নেতৃত্বের আসনে সমাসীন। সাধারণ জনগণও আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো, তারা প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে হজ্জ্বের অনুষ্ঠান পালন করতো। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা এসে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় এসে মিলিত হত। মূলত এরা তো ছিল ক্বাবা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আঃ)-এর বংশধর। যার কারণে ধর্মের একটি নিশানা তখনও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মদীনার ইহুদীরাও ছিল ধর্মীয় নেতৃত্বের আসনে আসীন। তারা ছিল কিতাবধারী বা আহলে কিতাব। তাদের মধ্যে বড় বড় আলেম ও পীর বোযর্গের অভাব ছিল না। বরং ধর্মীয় কারণেই সাধারণ জনগণের মধ্যে তাদের একটি প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান ছিল। কাজেই বিষয়টি এমন ছিল না যে, আরবের লোকেরা ধর্ম-বিরোধী বা নাস্তিক হওয়ার কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে ধর্মপথে আনার জন্য হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
আসলে ধর্মভাবের কোন কমতি সে সময়েও ছিল না। বরং ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর ও জাক-জমকটা তখন একটু বেশি পরিমাণেই ছিল। কোরাইশ আর ইহুদী নেতাদের মধ্যে লেবাস আর বুযুর্গীর প্রতিযোগিতা প্রকটভাবেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ধর্মের বাহ্যিক আবরণ ও আনুষ্ঠানিকতা বিদ্যমান থাকলেও ধর্মের মূল স্পিরিট বা প্রাণ স্পন্দন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বা তাওহীদি চেতনাই তাদের মধ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছিল। এ কারণেই পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন :
‘তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, এই জমিন ও এর সকল অধিবাসী কার? যদি তোমরা জানো, তবে বল। তারা অবশ্যই বলবে, সবই আল্লাহর। জিজ্ঞেস কর, তাহলে তোমরা সতর্ক হওনা কেন? তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, অসংখ্য আকাশ ও মহান আরশের মালিক কে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। বল, তাহলে তোমরা ভয় কর না কেন? তাদেরকে বল, তোমরা যদি জানো, তবে বল, সব জিনিসের উপর কার কর্তৃত্ব চলছে? আর কে আছে যিনি আশ্রয় দেন? তাঁর মোকাবেলায় আর কেউ কি আছে আশ্রয় দেয়ার? তারা নিশ্চয়ই বলবে, এটা তো আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। বল, তাহলে তোমরা কেন ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছো? বরং প্রকৃত ব্যাপার হল, আমরা তোমাদের সামনে যা উপস্থাপন করেছি তাই সত্য। আর এই লোকেরা নিশ্চিত মিথ্যেবাদী।’-[আল মু’মিনুন : ৮৪-৯০]
‘তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, তাদেরকে কে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই জবাবে বলবে আল্লাহ। তাহলে কী করে তারা পিছনে ফিরে যাচ্ছে?-[আয যুখরুখ : ৮৭]
এখনকার মত তখনও আল্লাহর নামের জপ ও জিকির আজকার ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রচলন কম ছিল না, কিন্তু আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে, তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে যথার্থ ধারণা মানুষের মধ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছিল। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একত্ববাদের স্থলে জায়গা করে নিয়েছিল শিরক ও পৌত্তলিকতা। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির, আল্লাহর সাথে বান্দার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের কোন সুযোগ তখন মানুষের ছিল না। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বহু মধ্যস্বত্বভোগী ধর্মীয় গোষ্ঠী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বন্ধু-বান্ধব (পীর-আউলিয়া) ও আত্মীয়-স্বজনের দাবীদার (নাউযুবিল্লাহ) এসব ধর্মব্যবসায়ী মধ্যস্বত্তভোগীরাই মানুষের আসল খোদা ও ভাগ্য-বিধাতা সেজে বসেছিল। আর এই ভূল বিশ্বাস ও বিভ্রান্ত জীবনবোধের ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল সে সময়ের জাহেলী সমাজ। এই বিভ্রান্ত ও ভন্ড ধর্ম-ব্যবসায়ীদেরকে খোদায়ীর আসন থেকে সমূলে উৎখাত করা এবং জাহেলী সমাজকে সংশোধন করে নির্ভেজাল তাওহীদী চেতনার ভিত্তিতে একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল রাসূলের কাজ।
আর এ কাজের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্ত, কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও অন্ধ আনুগত্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বের ঘোষণা দেয়া এবং এর ভিত্তিতে মানুষের চিন্তা-চেতনার পুনর্গঠন করা। এ লক্ষেই সূরা মুদ্দাস্সিরের উপরোক্ত ভাষণ নাযিল হয়। এরপর সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে নাযিল হয় সূরা আল ফাতিহা। তাতে শিরক বা পৌত্তলিকতার মূল ভিত্তি পুরোহিততন্ত্র তথা ব্যক্তিপূজা ও দেবতাতন্ত্রের উপর কুঠারাঘাত করে করে ঘোষণা করা হয় -
‘সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের রব ( মালিক, প্রতিপালক, অভিভাবক, শাসক, বিধানদাতা ও পরিচালক)। যিনি পরম দয়াময় ও অত্যন্ত মেহেরবান। এবং বিচার দিনের মালিক। আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সঠিক ও সরল পথের সন্ধান দাও। ঐসব লোকের পথ, যাদেরকে তুমি পুরুষ্কৃত করেছো। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।’
আসলে একটি সমাজে পৌত্তলিকতার উত্থান একদিনে হয় না। যে কাবাঘর ছিল তাওহীদের কেন্দ্রভূমি সেই কাবাঘরেই এক সময় মূর্তিপূজা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এবং তা একদিনে হয়নি। মূর্তি বা দেব-দেবীর পূজা নিঃসন্দেহে শিরকের চূড়ান্ত রূপ; কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয় ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের উপর দেবত্ব আরোপের মধ্য দিয়ে। মূলত, কোন মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষকে যখন অতিমানব মনে করা হয়, তখনই তার উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। এর প্রকাশ দেখা যায় পুরোহিততন্ত্র, পীর পূজা, ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে ইহুদি ও খৃষ্টানরা তাদের পূর্বপুরুষ মনে করে।
মক্কার কুরাইশরাও কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এরই বংশধর এবং পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম বা সেবায়েত। আর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সারা জীবন তাওহীদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ও তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইসমাইল (আঃ) পবিত্র কাবাঘরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাওহীদের কেন্দ্র রূপেই। অথচ তাঁদেরই বংশধর মক্কার অধিবাসীরা পবিত্র কাবাঘরকে মূর্তিপূজার আখড়ায় পরিণত করেছিল। অন্যদিকে ইহুদিরা হযরত ওজাইরকে আর খৃষ্টানরা হযরত ঈশা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্রে পরিণত করেছিল। এটি একদিনে হয়নি। আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকে বড় করে তোলা তথা ব্যক্তিপূজার পথ ধরেই শত শত বছরের বিকৃতির এক পর্যায়ে পৌত্তলিকতার প্রকাশ্যরূপ মূর্তিপূজা আত্মপ্রকাশ করে।
এভাবে ক্রমান্বয়ে আরো অসংখ্য আয়াত নাযিল হতে থাকে যাতে মানুষের সামনে আল্লাহর সঠিক পরিচয়, তাঁর সত্তা ও গুণাবলী তুলে ধরা হয় এবং তাদেরকে সকল ধরনের অন্ধ আনুগত্য ও শিরকের পংকিলতা থেকে মুক্ত হয়ে কেবল আল্লাহর গোলামী ও তাঁর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের আহবান জানানো হয়। যেমন :
‘বল, তিনিই আল্লাহ, যিনি একক (অবিভাজ্য ও অদ্বিতীয়), আল্লাহ মুখাপেক্ষিহীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ; তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনিও কারো সন্তান নন; তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’ -[ সূরা ইখলাস ]
‘বল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যাঁর কোন সন্তান কিংবা সাম্রাজ্য পরিচালনায় কোন অংশীদার নেই। তিনি কখনো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন না যে তাঁর কোন সাহায্যকারী প্রয়োজন হবে। সুতরাং তুমি তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে থাকো।’ -[বনী ইসরাইল : ১১১]
‘তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্যে জমিনকে বাসস্থান করেছেন আর আসমানকে করেছেন ছাদ স্বরূপ। তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন আর তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন। তিনি পবিত্র বস্তু থেকে তোমাদের রিজিক সরবরাহ করেছেন। সে আল্লাহই তোমাদের প্রভু। বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালক এবং মহান মর্যাদা ও সমৃদ্ধির মালিক। তিনি চিরঞ্জীব। কার্যত তিনি ছাড়া আর কেউ যথার্থ হুকুমকর্তা ও বিধানদাতা নেই। সুতরাং দ্বীনকে (আনুগত্য বা জীবন-ব্যবস্থাকে) একান্তভাবে তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট করে তোমরা কেবলমাত্র তাঁকেই ডাকো। সকল প্রশংসা কেবলমাত্র সেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের জন্যই।’ - [আল মুমিন : ৬৪-৬৫]
‘বল, নভম-ল ও ভূ-ম-লে যা কিছু আছে তার মালিক কে? বলে দাও, সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি অনুগ্রহ প্রদর্শনকে নিজ দায়িত্ব বলে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করবেন, যার আগমনে কোন সন্দেহ নেই। যারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তারাই বিশ্বাস স্থাপন করে না। যা কিছু রাত ও দিনে স্থিতি লাভ করে সবই তাঁর। তিনি সর্বশ্রোতা, সবজান্তা।’ -[আনআম : ১২-১৩]
‘কোন কিছু তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।’ -[আশ শূরা : ১১]
‘আল্লাহ যদি তোমাকে কোন কষ্ট দেন তবে তিনি ছাড়া তা অপসারণকারী আর কেউ নেই। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার মঙ্গল করেন (তবে তা সম্ভব, কেননা) তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত স্বীয় বান্দাদের উপর। তিনি মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ।’ -[আল আনআম : ১৭-১৮]
‘জিজ্ঞেস কর, সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যদাতা কে? বলে দাও - আল্লাহ। তিনি তোমাদের ও আমার মধ্যে সাক্ষী। আমার প্রতি এ কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে যেন আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কোরআন পৌঁছুবে সবাইকে সাবধান করি। তোমরা কি সাক্ষ দাও যে আল্লাহর সাথে আরো কোন আল্লাহ রয়েছে? বলে দাও আমি এ ধরনের সাক্ষ দিব না। বল, তিনিই একমাত্র উপাস্য ও প্রভু, আমি অবশ্যই তোমাদের কৃত শিরক থেকে মুক্ত।’ -[আল আনআম : ১৯]
‘বল, দ্বীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি। সর্বপ্রথম আমাকেই আনুগত্যের মস্তক অবনত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ... বল, আমার দ্বীনকে আল্লাহর জন্য একান্তভাবে নির্দিষ্ট করে আমি শুধু তাঁরই আনুগত্য-দাসত্ব করবো। তোমাদরে অবশ্য তাকে পরিত্যাগ করে যাকে ইচ্ছা তার গোলামী করেও বেড়াতে পারো ... (তবে) যারা তাগুতের (অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী) দাসত্ব ত্যাগ করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের জন্যই রয়েছে সুসংবাদ।’ - [আয-যুমার : ১১-১৭]
‘আমরা তোমাদের প্রতি সঠিক গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং আল্লাহর জন্যে দ্বীনকে খালেছ করে কেবল তারই ইবাদত কর। সাবধান, দ্বীন একনিষ্ঠভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত ও নির্দিষ্ট।’ -[আয-যুমার : ২-৩]
‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। দ্বীন একান্তভাবে তাঁর জন্যেই নিবেদিত। তবুও কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তোমরা ভয় করবে ?’ - [আন-নাহাল : ৫২]
‘তারা কি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে দ্বীন তালাশ করে? অথচ আসমান-জমিনের প্রতিটি বস্তু ইচ্ছায় হোক-অনিচ্ছায় হোক আল্লাহরই নির্দেশ মেনে চলছে। আর তারই কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’ - [আল ইমরান : ৮৩]
‘শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য নির্দিষ্ট নয়। তাঁরই নির্দেশ, তিনি ব্যতীত আর কারো আনুগত্য-দাসত্ব-বন্দেগী করো না। এটাই সত্য-সঠিক দ্বীন।’ - [ইউসুফ : ৩০]
‘আনুগত্যব্যবস্থাকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য খালেছ করা ব্যতীত তাদেরকে অন্য কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি।’
‘তুমি যাকে চাও তাকেই হেদায়াত করতে পারো না। কেন না আল্লাহ যাকে চান তাকেই হেদায়াত করে থাকেন। তিনিই জানেন কে হেদায়াত গ্রহণ করবে।’ -[আল কাসাস : ৫৬]
‘বল, আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমাকে এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে এবং সর্ব প্রথম আমি নিজেই তাঁর কাছে আনুগত্যের মস্তক অবনত করলাম।’ -[আল আনআম : ১৬২-১৬৩]
‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পুরোহিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে। মরিয়ম পুত্র ইসাকেও মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে একমাত্র একটি জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। ইবাদত করারই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তারা যে সব জিনিসকে তাঁর সাথে শরীক করে তা থেকে তিনি পবিত্র।’ -[আত তওবা : ৩১]
‘জেনে রাখ, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। আর এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের পিছনে পড়ে আছে, যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করছে, তা তাদের উদ্ভট ধারণা-কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুত এরা কল্পনা বিলাসী।’ -[ইউনুস : ৬৬]
‘যারা আল্লাহর সাথে অন্যকে ইলাহ মনে করে তাদের কাছে কোন দলিল-প্রমাণ নেই।’ -[আল মু’মিনুন : ১১৭]
‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন-বিধান দেয়ার এখতিয়ার নেই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদত করো না। এটিই সরল সোজা পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’ -[ইউসুফ : ৪০]
‘আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, রিযিক দিচ্ছেন, এরপর তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন এবং পুনরায় জীবিত করে ওঠাবেন। তোমাদের শরীকদের মধ্যে এমন কি কেউ আছে, যে এসব কাজের মধ্যে কোন একটি করতে পারে? তারা যা শরীক করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র ও মহান।’ -[আর রূম :৪০]
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর চেয়েও নিু পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করলো, সে যেন (আল্লাহর উপর) বড় অপবাদ আরোপ করল।’-[আন নিসা : ৪৮]
‘যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলল : হে পুত্র, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক ক’রো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে বড় যুলুম।’ -[লোকমান : ১৩]
আল্লাহর একত্ববাদের পাশাপাশি আল কোরআনে শিরকের ব্যাপারেও করা হয়েছে সমালোচনা ও কঠোর হুশিয়ারী। যেমন :
‘অবশ্যই যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, তাদের ওপর পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে পার্থিব জীবনেই গজব ও লাঞ্ছনা এসে পড়বে। এমনি করেই আমি অপবাদ আরোপকারীদের শাস্তি দিয়ে থাকি।’ -[আল আরাফ : ১৫২]
‘তারা যাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছে, তারা আল্লাহর পথ থেকে তাদেরকে বিচ্যূত করে দেয়। বল, মজা লুটে নাও, পরিণতিতে আগুনের দিকেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।’ -[ইব্রাহিম : ৩০]
‘তোমরা এবং আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা তোমরা কর, তারা সবাই জাহান্নামের ইন্ধন হবে। তোমরা সবাই সেখানে প্রবেশ করবে।’ -[আল আম্বিয়া : ৯৮]
‘যারা বলে মরিয়ম পুত্র মস্-ীই আল্লাহ, তারা কাফের। অথচ মসীহ্ বলেন, হে বনী ইসরাইল! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।’ -[আল মায়িদা : ৭২]
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না, যে তাঁর সাথে শরীক করে। এছাড়া আর সমস্ত গুনাহ-ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন মাফ করে দেন। যে শিরক করল সে যেন আল্লাহর উপর শক্ত অপবাদ আরোপ করল।’ -[আন নিসা : ৪৮]
এভাবে পবিত্র কোরআন মজিদের পরতে পরতে আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং রাসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আল্লাহর এ ঘোষণা অনুযায়ী মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করার জন্য। বিশেষ করে মাক্কী যুগের তেরো বছরে রাসূলের মিশনের প্রধান কাজই ছিল আল্লাহর একত্ববাদের আলোকে মানুষের মন-মানসিকতা ও তাদের জীবনকে পুনর্গঠন করা, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। আর মাক্কী যুগের সূরাগুলোরও কেন্দ্রিয় আলোচ্য বিষয় ছিল মানুষের কাছে আল্লাহর পরিচয়কে সুস্পষ্ট করে তোলা এবং শিরকের পংকিলতা থেকে তাদেরকে রক্ষা করা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আল্লাহর প্রভুত্ত, কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়াই ছিল মহানবীর নবুয়তী জিন্দেগীর প্রধান মিশন এবং মূলত তাওহীদের এই শাশ্বত ঘোষণাই ইসলামের চিরন্তন ও শাশ্বত দাওয়াত। আল্লাহর নির্দেশে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে, বিশ্বনবী বা মহানবী হিসেবেও হযরত মুহাম্মাদ ও (সঃ) মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে এই শাশ্বত আহবানই জানাতেন :
‘হে লোক সকল, তোমরা ঘোষণা কর, আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রভু নেই, তাহলে তোমরা সফল হবে।’ অর্থাৎ لا اله الاالله ঘোষণাই ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দাওয়াত। আল্লাহর নির্দেশে প্রথমে তিনি কিছুকাল গোপনে তার নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছে দ্বীনের এ দাওয়াত প্রচার করেন। পরে যখন প্রকাশ্য দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে একদিন তিনি কুরাইশদেরকে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত করে বললেন :
‘আমি যদি তোমাদের বলি, এই পাহাড়ের অপর পাশে হানাদার বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে ছুটে আসছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? সমবেত জনগণ সমস্বরে বলে উঠল : ‘হা, কেন করবো না? আমরা তোমাকে সব সময় সত্য বলতে দেখেছি।’
‘তাহলে হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, হে আবদ মানাফের বংশধর, হে যাহরার বংশধর, হে তামীমের সন্তানেরা, হে মাখযুমের সন্তানেরা, ওহে আসাদের বংশধর, শোন, আমি বলছি, তোমরা এক আল্লাহকে প্রভু ও উপাস্য মেনে নাও, তা না হলে তোমাদের উপর কঠিন আযাব নেমে আসবে।’
দাওয়াত ও তাবলীগ
‘তোমার প্রতিপালকের দিকে মানুষকে আহবান কর কৌশল আর সদুপদেশের মাধ্যমে। এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে আলোচনা কর। তোমার প্রতিপালক তাঁর পথ থেকে বিচ্যূত লোকদের যেমন জানেন, তেমনি সত্য পথের পথিকদের সম্পর্কেও তিনি বিশেষভাবে অবহিত।’ -[সূরা নাহ্ল : ১২৫]
মহানবীর রিসালাতের প্রথম ও প্রধান মিশন ছিল দাওয়াতের আমল বা আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করা। দাওয়াত (دعوت) শব্দের আবিধানিক অর্থ হচ্ছে আহবান করা, আমন্ত্রণ জানানো। আর তাবলীগ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রচার। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় দাওয়াত ও তাবলীগ বলতে বুঝায় মানুষের কল্যাণ কামনায় ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্যকে, এর কল্যাণকর জীবনাদর্শ ও মাহাত্মকে সৎভাবে, শুভাকাক্সিক্ষ ও বন্ধুত্বের মন নিয়ে বিভিন্ন সুন্দর কৌশলের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং প্রচার করা।
দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগ তথা ইসলামের দিকে, ইসলামী মূল্যবোধের দিকে মানুষকে আহবান ও এর প্রচার একটি ফরজি আমল। আল্লাহর দিকে আহবান বা দায়ী ইলাল্লাহর কাজ নামাজ রোজার মতই একটি ফরজ ও মৌলিক ইবাদত। সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ও তার সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন সহ উম্মতে মুসলিমার সকল যুগের বুযুর্গ ব্যক্তিগণ দায়ী ইলাল্লাহর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য সবার আগে মানুষের চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় প্রতিষ্ঠিত জাহেলী, খোদাবিমুখ, পৌত্তলিক ও ভোগবাদী সমাজের যে প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে বাসা বেঁধে আছে তাকে ঘষে-মেজে পরিষ্কার-পরিশুদ্ধ করে মানুষের মাঝে ইসলামী মন-মানসিকতা তৈরি করতে হলে, মানুষের ভোগবাদী ও দুনিয়াপূজারী মনকে সংযমী ও আল্লাহমুখি করতে হলে ইসলামী আদর্শের, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাতে পয়গাম প্রচার এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তো আগে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষেরা যদি সত্যের আহবানকে না জানে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য যদি বুঝতে না পারে, তাহলে তারা জাহেলিয়াতের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাবে কীভাবে? একারণেই দায়ী ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর দিকে আহবান ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সহ সমস্ত নবী-রাসূলদের জীবনের অন্যতম প্রধান মিশন। পবিত্র কোরআনে এবং মহানবীর হাদীসে এই মহান মিশন সম্পর্কে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা।
আমরা আগেই বলেছি, দাওয়াত ও তাবলীগ অর্থ আহবান ও প্রচার। মূলত এটি একটি বিরাট ও ব্যাপক বিষয়। এ কাজটিকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে বহুমুখী কর্মসূচী পালন করতে হয়েছিল। আলোচনার সুবিধার জন্য এই বিরাট ও ব্যাপক কাজের আলোচনাকে কয়েকটিকে ভাগ করা যায়।
যেমন :
ক. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা বা তাওহীদের প্রচার ও শিরকের মূলোৎপাটন;
খ. আল্লাহর কালামকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া বা কোরআন প্রচার এবং
গ. রিসালাতের ঘোষণা
ঘ. আখেরাতের আদালতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করে তোলা ।
এখন আমরা এ বিষয়গুলোকে আরেকটু বিস্তারিত ভাবে আলোচনার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ক. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা
যেদিন হেরা গুহায় প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদের উপর প্রথম ওহী নাযিল হয়, সেদিন থেকেই শুরু হয় একটি নতুন জীবনবোধের উদ্বোধন। নতুন অথচ চিরন্তন, শাশ্বত ও সনাতন। নতুন বলার একটি কারণ হল, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, সঠিক ধারণা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ পেতে থাকে সেদিন থেকেই। আর এ নতুন জীবনবোধের প্রথম পাঠই হল আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা। সূরা আল আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাযিলের পর আল্লাহ তায়া’লা তাঁর নবীকে গণসংযোগের প্রথম যে নির্দেশ দেন তা ছিল সূরা আল মুদ্দাস্সির-এর প্রথম সাত আয়াত। তাতে বলা হয়-
‘হে চাদর আবৃত্ত শয্যাগ্রহণকারী, ওঠো, সাবধান কর, আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। আর নিজের পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। মলিনতা অপবিত্রতা থেকে দূরে থাক। আর অনুগ্রহ ক'রো না বেশি পাওয়ার আশায়। এবং নিজের রবের জন্য ধৈর্য ধারণ কর।’-[মুদ্দাস্সির : ১-৩]
আমরা দেখতে পাচ্ছি আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীকে নবুয়তী দায়িত্ব অর্পন করে সর্ব প্রথম যে নির্দেশ দিচ্ছেন তা হল গণসংযোগের নির্দেশ, মানুষকে সাবধান ও সতর্ক করার নির্দেশ এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণার নির্দেশ। সাথে সাথে একজন দায়ী ইলাল্লাহর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে কী কী গুণাবলী থাকতে হবে সে হেদায়াতও তিনি দিয়ে দিচ্ছেন। বস্তুত যে নতুনত্বের ইঙ্গিত সূরা আলাকে দেয়া হয়েছিল, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বা তাওহীদের ঘোষণা হল সেই নতুন জীবন মিশনের প্রথম পদক্ষেপ। মূলত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য ইসলামী জীবনপদ্ধতির প্রাণস্পন্দন। এই বিশ্বলোকে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শ্রেষ্ঠত্ব-প্রাধান্য নাই Ñ এ কথাটিই ইসলামের মূলমন্ত্র। ঠিক এ কারণেই ইসলামে ‘আল্লাহ আকবার’ কথাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আযানের শুরুতেই আল্লাহু আকবার ঘোষণাটি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে। মুসলমানরা নামাজও শুরু করে আল্লাহু আকবার’ কথাটি উচ্চারণের মাধ্যমে। পশু যবেহ করতে হলেও বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার বলেই তা শুরু করতে হয়। বর্তমানেও তাকবির ধ্বনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যের সবচেয়ে বৈশিষ্টপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত। এসবেরই কারণ হল ইসলামের নবী সর্ব শক্তিমান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও বড়ত্বের ঘোষণা প্রদানের মধ্য দিয়েই তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন।
মনে রাখা প্রয়োজন, যে যুগ-প্রতিবেশে কোরআন নাযিল শুরু হয়, মক্কার সে সমাজের মানুষগুলো কিন্তু ধর্ম বিরোধী ছিল না। বরং তারা ছিল ধর্মনেতা। পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম বা মোতওয়াল্লি হওয়ার কারণে সমগ্র আরবের মধ্যে কুরাইশরা ছিল নেতৃত্বের আসনে সমাসীন। সাধারণ জনগণও আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো, তারা প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে হজ্জ্বের অনুষ্ঠান পালন করতো। দূর-দূরান্ত থেকে লোকেরা এসে পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় এসে মিলিত হত। মূলত এরা তো ছিল ক্বাবা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আঃ)-এর বংশধর। যার কারণে ধর্মের একটি নিশানা তখনও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মদীনার ইহুদীরাও ছিল ধর্মীয় নেতৃত্বের আসনে আসীন। তারা ছিল কিতাবধারী বা আহলে কিতাব। তাদের মধ্যে বড় বড় আলেম ও পীর বোযর্গের অভাব ছিল না। বরং ধর্মীয় কারণেই সাধারণ জনগণের মধ্যে তাদের একটি প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান ছিল। কাজেই বিষয়টি এমন ছিল না যে, আরবের লোকেরা ধর্ম-বিরোধী বা নাস্তিক হওয়ার কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে ধর্মপথে আনার জন্য হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
আসলে ধর্মভাবের কোন কমতি সে সময়েও ছিল না। বরং ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর ও জাক-জমকটা তখন একটু বেশি পরিমাণেই ছিল। কোরাইশ আর ইহুদী নেতাদের মধ্যে লেবাস আর বুযুর্গীর প্রতিযোগিতা প্রকটভাবেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ধর্মের বাহ্যিক আবরণ ও আনুষ্ঠানিকতা বিদ্যমান থাকলেও ধর্মের মূল স্পিরিট বা প্রাণ স্পন্দন আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বা তাওহীদি চেতনাই তাদের মধ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছিল। এ কারণেই পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেন :
‘তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, এই জমিন ও এর সকল অধিবাসী কার? যদি তোমরা জানো, তবে বল। তারা অবশ্যই বলবে, সবই আল্লাহর। জিজ্ঞেস কর, তাহলে তোমরা সতর্ক হওনা কেন? তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, অসংখ্য আকাশ ও মহান আরশের মালিক কে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। বল, তাহলে তোমরা ভয় কর না কেন? তাদেরকে বল, তোমরা যদি জানো, তবে বল, সব জিনিসের উপর কার কর্তৃত্ব চলছে? আর কে আছে যিনি আশ্রয় দেন? তাঁর মোকাবেলায় আর কেউ কি আছে আশ্রয় দেয়ার? তারা নিশ্চয়ই বলবে, এটা তো আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। বল, তাহলে তোমরা কেন ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছো? বরং প্রকৃত ব্যাপার হল, আমরা তোমাদের সামনে যা উপস্থাপন করেছি তাই সত্য। আর এই লোকেরা নিশ্চিত মিথ্যেবাদী।’-[আল মু’মিনুন : ৮৪-৯০]
‘তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, তাদেরকে কে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই জবাবে বলবে আল্লাহ। তাহলে কী করে তারা পিছনে ফিরে যাচ্ছে?-[আয যুখরুখ : ৮৭]
এখনকার মত তখনও আল্লাহর নামের জপ ও জিকির আজকার ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রচলন কম ছিল না, কিন্তু আল্লাহর পরিচয়, আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে, তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে যথার্থ ধারণা মানুষের মধ্য থেকে সম্পূর্ণভাবে বিদায় নিয়েছিল। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একত্ববাদের স্থলে জায়গা করে নিয়েছিল শিরক ও পৌত্তলিকতা। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির, আল্লাহর সাথে বান্দার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের কোন সুযোগ তখন মানুষের ছিল না। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বহু মধ্যস্বত্বভোগী ধর্মীয় গোষ্ঠী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বন্ধু-বান্ধব (পীর-আউলিয়া) ও আত্মীয়-স্বজনের দাবীদার (নাউযুবিল্লাহ) এসব ধর্মব্যবসায়ী মধ্যস্বত্তভোগীরাই মানুষের আসল খোদা ও ভাগ্য-বিধাতা সেজে বসেছিল। আর এই ভূল বিশ্বাস ও বিভ্রান্ত জীবনবোধের ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল সে সময়ের জাহেলী সমাজ। এই বিভ্রান্ত ও ভন্ড ধর্ম-ব্যবসায়ীদেরকে খোদায়ীর আসন থেকে সমূলে উৎখাত করা এবং জাহেলী সমাজকে সংশোধন করে নির্ভেজাল তাওহীদী চেতনার ভিত্তিতে একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল রাসূলের কাজ।
আর এ কাজের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্ত, কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও অন্ধ আনুগত্যের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বের ঘোষণা দেয়া এবং এর ভিত্তিতে মানুষের চিন্তা-চেতনার পুনর্গঠন করা। এ লক্ষেই সূরা মুদ্দাস্সিরের উপরোক্ত ভাষণ নাযিল হয়। এরপর সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে নাযিল হয় সূরা আল ফাতিহা। তাতে শিরক বা পৌত্তলিকতার মূল ভিত্তি পুরোহিততন্ত্র তথা ব্যক্তিপূজা ও দেবতাতন্ত্রের উপর কুঠারাঘাত করে করে ঘোষণা করা হয় -
‘সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের রব ( মালিক, প্রতিপালক, অভিভাবক, শাসক, বিধানদাতা ও পরিচালক)। যিনি পরম দয়াময় ও অত্যন্ত মেহেরবান। এবং বিচার দিনের মালিক। আমরা কেবলমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সঠিক ও সরল পথের সন্ধান দাও। ঐসব লোকের পথ, যাদেরকে তুমি পুরুষ্কৃত করেছো। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে।’
আসলে একটি সমাজে পৌত্তলিকতার উত্থান একদিনে হয় না। যে কাবাঘর ছিল তাওহীদের কেন্দ্রভূমি সেই কাবাঘরেই এক সময় মূর্তিপূজা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এবং তা একদিনে হয়নি। মূর্তি বা দেব-দেবীর পূজা নিঃসন্দেহে শিরকের চূড়ান্ত রূপ; কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয় ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের উপর দেবত্ব আরোপের মধ্য দিয়ে। মূলত, কোন মানুষ বা ব্যক্তি বিশেষকে যখন অতিমানব মনে করা হয়, তখনই তার উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। এর প্রকাশ দেখা যায় পুরোহিততন্ত্র, পীর পূজা, ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তি বিশেষের অন্ধভক্তি ও অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে ইহুদি ও খৃষ্টানরা তাদের পূর্বপুরুষ মনে করে।
মক্কার কুরাইশরাও কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল (আঃ)-এরই বংশধর এবং পবিত্র কাবা ঘরের খাদেম বা সেবায়েত। আর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সারা জীবন তাওহীদের প্রচার ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ও তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইসমাইল (আঃ) পবিত্র কাবাঘরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাওহীদের কেন্দ্র রূপেই। অথচ তাঁদেরই বংশধর মক্কার অধিবাসীরা পবিত্র কাবাঘরকে মূর্তিপূজার আখড়ায় পরিণত করেছিল। অন্যদিকে ইহুদিরা হযরত ওজাইরকে আর খৃষ্টানরা হযরত ঈশা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্রে পরিণত করেছিল। এটি একদিনে হয়নি। আদর্শের পরিবর্তে ব্যক্তিকে বড় করে তোলা তথা ব্যক্তিপূজার পথ ধরেই শত শত বছরের বিকৃতির এক পর্যায়ে পৌত্তলিকতার প্রকাশ্যরূপ মূর্তিপূজা আত্মপ্রকাশ করে।
এভাবে ক্রমান্বয়ে আরো অসংখ্য আয়াত নাযিল হতে থাকে যাতে মানুষের সামনে আল্লাহর সঠিক পরিচয়, তাঁর সত্তা ও গুণাবলী তুলে ধরা হয় এবং তাদেরকে সকল ধরনের অন্ধ আনুগত্য ও শিরকের পংকিলতা থেকে মুক্ত হয়ে কেবল আল্লাহর গোলামী ও তাঁর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের আহবান জানানো হয়। যেমন :
‘বল, তিনিই আল্লাহ, যিনি একক (অবিভাজ্য ও অদ্বিতীয়), আল্লাহ মুখাপেক্ষিহীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ; তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনিও কারো সন্তান নন; তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’ -[ সূরা ইখলাস ]
‘বল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যাঁর কোন সন্তান কিংবা সাম্রাজ্য পরিচালনায় কোন অংশীদার নেই। তিনি কখনো দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন না যে তাঁর কোন সাহায্যকারী প্রয়োজন হবে। সুতরাং তুমি তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে থাকো।’ -[বনী ইসরাইল : ১১১]
‘তিনি আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্যে জমিনকে বাসস্থান করেছেন আর আসমানকে করেছেন ছাদ স্বরূপ। তিনি তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন আর তাকে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন। তিনি পবিত্র বস্তু থেকে তোমাদের রিজিক সরবরাহ করেছেন। সে আল্লাহই তোমাদের প্রভু। বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালক এবং মহান মর্যাদা ও সমৃদ্ধির মালিক। তিনি চিরঞ্জীব। কার্যত তিনি ছাড়া আর কেউ যথার্থ হুকুমকর্তা ও বিধানদাতা নেই। সুতরাং দ্বীনকে (আনুগত্য বা জীবন-ব্যবস্থাকে) একান্তভাবে তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট করে তোমরা কেবলমাত্র তাঁকেই ডাকো। সকল প্রশংসা কেবলমাত্র সেই আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের জন্যই।’ - [আল মুমিন : ৬৪-৬৫]
‘বল, নভম-ল ও ভূ-ম-লে যা কিছু আছে তার মালিক কে? বলে দাও, সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি অনুগ্রহ প্রদর্শনকে নিজ দায়িত্ব বলে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করবেন, যার আগমনে কোন সন্দেহ নেই। যারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তারাই বিশ্বাস স্থাপন করে না। যা কিছু রাত ও দিনে স্থিতি লাভ করে সবই তাঁর। তিনি সর্বশ্রোতা, সবজান্তা।’ -[আনআম : ১২-১৩]
‘কোন কিছু তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।’ -[আশ শূরা : ১১]
‘আল্লাহ যদি তোমাকে কোন কষ্ট দেন তবে তিনি ছাড়া তা অপসারণকারী আর কেউ নেই। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার মঙ্গল করেন (তবে তা সম্ভব, কেননা) তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত স্বীয় বান্দাদের উপর। তিনি মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ।’ -[আল আনআম : ১৭-১৮]
‘জিজ্ঞেস কর, সবচেয়ে বড় সাক্ষ্যদাতা কে? বলে দাও - আল্লাহ। তিনি তোমাদের ও আমার মধ্যে সাক্ষী। আমার প্রতি এ কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে যেন আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কোরআন পৌঁছুবে সবাইকে সাবধান করি। তোমরা কি সাক্ষ দাও যে আল্লাহর সাথে আরো কোন আল্লাহ রয়েছে? বলে দাও আমি এ ধরনের সাক্ষ দিব না। বল, তিনিই একমাত্র উপাস্য ও প্রভু, আমি অবশ্যই তোমাদের কৃত শিরক থেকে মুক্ত।’ -[আল আনআম : ১৯]
‘বল, দ্বীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি। সর্বপ্রথম আমাকেই আনুগত্যের মস্তক অবনত করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ... বল, আমার দ্বীনকে আল্লাহর জন্য একান্তভাবে নির্দিষ্ট করে আমি শুধু তাঁরই আনুগত্য-দাসত্ব করবো। তোমাদরে অবশ্য তাকে পরিত্যাগ করে যাকে ইচ্ছা তার গোলামী করেও বেড়াতে পারো ... (তবে) যারা তাগুতের (অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী) দাসত্ব ত্যাগ করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের জন্যই রয়েছে সুসংবাদ।’ - [আয-যুমার : ১১-১৭]
‘আমরা তোমাদের প্রতি সঠিক গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং আল্লাহর জন্যে দ্বীনকে খালেছ করে কেবল তারই ইবাদত কর। সাবধান, দ্বীন একনিষ্ঠভাবে কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত ও নির্দিষ্ট।’ -[আয-যুমার : ২-৩]
‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। দ্বীন একান্তভাবে তাঁর জন্যেই নিবেদিত। তবুও কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তোমরা ভয় করবে ?’ - [আন-নাহাল : ৫২]
‘তারা কি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে দ্বীন তালাশ করে? অথচ আসমান-জমিনের প্রতিটি বস্তু ইচ্ছায় হোক-অনিচ্ছায় হোক আল্লাহরই নির্দেশ মেনে চলছে। আর তারই কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’ - [আল ইমরান : ৮৩]
‘শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য নির্দিষ্ট নয়। তাঁরই নির্দেশ, তিনি ব্যতীত আর কারো আনুগত্য-দাসত্ব-বন্দেগী করো না। এটাই সত্য-সঠিক দ্বীন।’ - [ইউসুফ : ৩০]
‘আনুগত্যব্যবস্থাকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য খালেছ করা ব্যতীত তাদেরকে অন্য কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি।’
‘তুমি যাকে চাও তাকেই হেদায়াত করতে পারো না। কেন না আল্লাহ যাকে চান তাকেই হেদায়াত করে থাকেন। তিনিই জানেন কে হেদায়াত গ্রহণ করবে।’ -[আল কাসাস : ৫৬]
‘বল, আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন অংশীদার নেই। আমাকে এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে এবং সর্ব প্রথম আমি নিজেই তাঁর কাছে আনুগত্যের মস্তক অবনত করলাম।’ -[আল আনআম : ১৬২-১৬৩]
‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের পুরোহিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে। মরিয়ম পুত্র ইসাকেও মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে একমাত্র একটি জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। ইবাদত করারই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তারা যে সব জিনিসকে তাঁর সাথে শরীক করে তা থেকে তিনি পবিত্র।’ -[আত তওবা : ৩১]
‘জেনে রাখ, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। আর এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের পিছনে পড়ে আছে, যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করছে, তা তাদের উদ্ভট ধারণা-কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুত এরা কল্পনা বিলাসী।’ -[ইউনুস : ৬৬]
‘যারা আল্লাহর সাথে অন্যকে ইলাহ মনে করে তাদের কাছে কোন দলিল-প্রমাণ নেই।’ -[আল মু’মিনুন : ১১৭]
‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো আইন-বিধান দেয়ার এখতিয়ার নেই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদত করো না। এটিই সরল সোজা পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।’ -[ইউসুফ : ৪০]
‘আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, রিযিক দিচ্ছেন, এরপর তোমাদেরকে মৃত্যু দেবেন এবং পুনরায় জীবিত করে ওঠাবেন। তোমাদের শরীকদের মধ্যে এমন কি কেউ আছে, যে এসব কাজের মধ্যে কোন একটি করতে পারে? তারা যা শরীক করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র ও মহান।’ -[আর রূম :৪০]
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না যে লোক তাঁর সাথে শরীক করে। তিনি ক্ষমা করেন এর চেয়েও নিু পর্যায়ের পাপ, যার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করলো, সে যেন (আল্লাহর উপর) বড় অপবাদ আরোপ করল।’-[আন নিসা : ৪৮]
‘যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিয়ে বলল : হে পুত্র, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক ক’রো না। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে বড় যুলুম।’ -[লোকমান : ১৩]
আল্লাহর একত্ববাদের পাশাপাশি আল কোরআনে শিরকের ব্যাপারেও করা হয়েছে সমালোচনা ও কঠোর হুশিয়ারী। যেমন :
‘অবশ্যই যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে, তাদের ওপর পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে পার্থিব জীবনেই গজব ও লাঞ্ছনা এসে পড়বে। এমনি করেই আমি অপবাদ আরোপকারীদের শাস্তি দিয়ে থাকি।’ -[আল আরাফ : ১৫২]
‘তারা যাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছে, তারা আল্লাহর পথ থেকে তাদেরকে বিচ্যূত করে দেয়। বল, মজা লুটে নাও, পরিণতিতে আগুনের দিকেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।’ -[ইব্রাহিম : ৩০]
‘তোমরা এবং আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা তোমরা কর, তারা সবাই জাহান্নামের ইন্ধন হবে। তোমরা সবাই সেখানে প্রবেশ করবে।’ -[আল আম্বিয়া : ৯৮]
‘যারা বলে মরিয়ম পুত্র মস্-ীই আল্লাহ, তারা কাফের। অথচ মসীহ্ বলেন, হে বনী ইসরাইল! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।’ -[আল মায়িদা : ৭২]
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না, যে তাঁর সাথে শরীক করে। এছাড়া আর সমস্ত গুনাহ-ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন মাফ করে দেন। যে শিরক করল সে যেন আল্লাহর উপর শক্ত অপবাদ আরোপ করল।’ -[আন নিসা : ৪৮]
এভাবে পবিত্র কোরআন মজিদের পরতে পরতে আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং রাসূলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আল্লাহর এ ঘোষণা অনুযায়ী মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করার জন্য। বিশেষ করে মাক্কী যুগের তেরো বছরে রাসূলের মিশনের প্রধান কাজই ছিল আল্লাহর একত্ববাদের আলোকে মানুষের মন-মানসিকতা ও তাদের জীবনকে পুনর্গঠন করা, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করা। আর মাক্কী যুগের সূরাগুলোরও কেন্দ্রিয় আলোচ্য বিষয় ছিল মানুষের কাছে আল্লাহর পরিচয়কে সুস্পষ্ট করে তোলা এবং শিরকের পংকিলতা থেকে তাদেরকে রক্ষা করা।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আল্লাহর প্রভুত্ত, কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়াই ছিল মহানবীর নবুয়তী জিন্দেগীর প্রধান মিশন এবং মূলত তাওহীদের এই শাশ্বত ঘোষণাই ইসলামের চিরন্তন ও শাশ্বত দাওয়াত। আল্লাহর নির্দেশে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে, বিশ্বনবী বা মহানবী হিসেবেও হযরত মুহাম্মাদ ও (সঃ) মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে এই শাশ্বত আহবানই জানাতেন :
‘হে লোক সকল, তোমরা ঘোষণা কর, আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রভু নেই, তাহলে তোমরা সফল হবে।’ অর্থাৎ لا اله الاالله ঘোষণাই ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দাওয়াত। আল্লাহর নির্দেশে প্রথমে তিনি কিছুকাল গোপনে তার নিকটাত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছে দ্বীনের এ দাওয়াত প্রচার করেন। পরে যখন প্রকাশ্য দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে একদিন তিনি কুরাইশদেরকে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত করে বললেন :
‘আমি যদি তোমাদের বলি, এই পাহাড়ের অপর পাশে হানাদার বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে ছুটে আসছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? সমবেত জনগণ সমস্বরে বলে উঠল : ‘হা, কেন করবো না? আমরা তোমাকে সব সময় সত্য বলতে দেখেছি।’
‘তাহলে হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, হে আবদ মানাফের বংশধর, হে যাহরার বংশধর, হে তামীমের সন্তানেরা, হে মাখযুমের সন্তানেরা, ওহে আসাদের বংশধর, শোন, আমি বলছি, তোমরা এক আল্লাহকে প্রভু ও উপাস্য মেনে নাও, তা না হলে তোমাদের উপর কঠিন আযাব নেমে আসবে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন