বুধবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২১

আত্মনিয়ন্ত্রণ



আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ ও তাৎপর্য

আত্মনিয়ন্ত্রণ (Self-control) হলো কোন ব্যক্তির নিজ অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মনিয়ন্ত্রণ ব্যক্তিকে তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।

আত্মনিয়ন্ত্রণ হচ্ছে একজন মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর অন্যতম। এটি এমন গুণ যা মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। মানুষের মধ্যে লোভ, স্বার্থপরতা, আরামপ্রিয়তা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি নানা রকম দোষ-ত্রুটি বা দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলোকে সংবরণ করা বা কাটিয়ে ওঠার জন্য মানুষের মধ্যে ভাল-মন্দের বোধ বা বিবেকও রয়েছে। যারা তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা এবং বিবেককে কাজে লাগিয়ে লোভ-লালসা ও অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে, হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ ইত্যাদি দোষ-ত্রুটি থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই যথার্থ মানুষ।

আত্মনিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব

জীবনে সফলতা লাভের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ বা স্ব-শৃংখলা একান্তই অপরিহার্য। ঘরে-বাইরে, স্কুলে কিংবা অফিসে যেখানেই আমরা অবস্থান করি না কেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। কখনই প্রবৃত্তির হাতে আমাদের জীবনের লাগাম তুলে দেয়া যাবে না। প্রবৃত্তিকে সব সময় বিবেকের কথা মত পরিচালনা করতে হবে। আমাদের নিজেদের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ এমনকি এই বিশ^ও বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়বে যদি আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা বিবেকবোধকে লালন না করি, বিবেকের কথা মত নিজেদেরকে পরিচালনা না করি। সুতরাং সর্বত্রই শৃংখলা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। আর তারজন্য আমাদের নিজেদের মধ্যে আগে স্ব-শৃংখলা বা আত্মনিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। এই বিশ^ চরাচরে বা প্রকৃতি জগতে শৃংখলা পুরোপুরি বিরাজমান। যদি এখানে সামান্য বিশৃংখলাও তৈরি হয় তাহলে প্রকৃতি জগতে বিপর্যয় নেমে আসবে। মাঝে মাঝে যেসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যায়, তার জন্য প্রকৃতি দায়ী নয়, বরং মানুষের উচ্ছৃংখলতার জন্যই পরিবেশ ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন ও বিপর্যয় দেখা দেয়।

স্কুল-কলেজের গঠনমূলক দিনগুলো

জীবনের প্রতিটি চলার পথে আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখতে হবে। আর এটি শেখার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হল শৈশব কাল। কারণ, তরুণ মন সহজে এবং দ্রুত সবকিছু শিখতে পারে। স্কুলে শিক্ষার্থীদেরকে ভাল আচরণ শেখানো হয়। তাদেরকে শেখানো হয় বড়দের সম্মান করতে এবং ছোটদের ¯েœহ করতে। এমনকি খেলার মাঠেও বালক/বালিকাদেরকে খেলার নিয়ম এবং তা অনুসরণের শিক্ষা দেয়া হয়। তাই ছাত্রজীবন, বিশেষ করে স্কুল-কলেজের দিনগুলো হলো মানব জীবনের সবচেয়ে গঠনমুখি সময়কাল, যে সময়ে আত্মনিয়ন্ত্রণবোধ শেখানো হয়।

নিয়ন্ত্রণহীনতার কুফল

আত্মমর্যাদা সম্পন্ন কোন মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে না। এটি মানুষের মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষের প্রকৃতিতে সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তি - দুই ধরনের প্রবণতা রয়েছে। কুপ্রবৃত্তি হচ্ছে মানুষের বস্তু-সত্তা বা জৈবিক সত্তা। আর সুপ্রবৃত্তি হচ্ছে মানুষের নৈতিক বা আত্মিক সত্তা। একে অন্তর, বিবেক, মনুষ্যত্ব ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। বস্তু সত্তা বা কুপ্রবৃত্তিকে পশু সত্তাও বলা যায়। এই পশু সত্তা পশু তথা সমস্ত প্রাণীকুলে মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু মনুষ্যত্ব বা বিবেক শুধু মানুষের মধ্যেই রয়েছে। পশু সত্তা বা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে সব সময় ভোগ, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, আরামপ্রিয়তা, চুরি, আত্মসাত ইত্যাদির দিকে ধাবিত করতে চায়। কিন্তু সুপ্রবৃত্তি মানুষকে সব সময় এসমস্ত কাজ থেকে বিরত রাখতে চায়। মানুষ যখনই কোন অন্যায়ের দিকে যেতে চাই তখনই তার বিবেক বা নৈতিক মূল্যবোধ তাকে বাধা প্রদান করে। এই বিবেকবোধ বা মনুষ্যত্বের কারণেই সমস্ত ইতর প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু মানুষ যখন বিবেকের বাধাকে উপেক্ষা করে যখন ক্রমাগত অন্যায় করতে থাকে বা আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে তখন তার বিবেকবোধ লোপ পায়। তখন সে পুরোপুরি কুপ্রবৃত্তির দাসে পরিণত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি ভাল ভাবে বুঝতে পারবে। ধরো, তুমি একটি গরু বা ছাগল পালন করো। তুমি তাদের যতœ করতে কখনো কার্পণ্য করো না। এই পশুগুলো যে গোয়াল ঘরে থাকে, তার পাশেই হয়তো তোমার একটি সখের বাগান রয়েছে। কিন্তু এই গরু বা ছাগল থেকে তোমার সখের বাগানটি রক্ষা করার জন্য তোমাকে সব সময়ই সতর্ক থাকতে হয়, কারণ সুযোগ পেলেই এরা তোমার সখের বাগানটিকে খেয়ে সাবার করে ফেলবে, একটিও দ্বিধা করবে না। এর কারণ কী? কারণ হলো, এরা তো পশু, এদের কোন বোধ বা বিবেক নেই। সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে জানে না। তার দরকার খাদ্য, কিন্তু এই খাদ্য কোত্থেকে আসলো, এটি খাওয়া ঠিক না বেঠিক এই বোধ তার নেই। মানুষের মধ্যেও কিছু মানুষ এরকম রয়েছে। তাদের আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তারা পশুর মতই আত্মনিয়ন্ত্রণহীন।

নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণ:

প্রথম কারণটি আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। সেটি হলো নৈতিক শিক্ষা বা বিবেকবোধের অভাব। এছাড়াও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, জনসংখ্যার আধিক্য ইত্যাদির কারণেও বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বেকারত্বের কারণে, আর্থিক সংকটের কারণে অনেক সময় মানুষ বাধ্য হয়েও অন্যায় করে থাকে। আবার জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে তার চাপ পরিবহণ, স্কুল কলেজ, বিশ^বিদ্যায়ল, চাকরি-বাকরি ইত্যাদিতে পড়ে এবং বিশৃংখলা, দুর্নীতি ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

আগেই বলেছি, আত্মনিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা মানুষের একটি মৌলিক মানবিক গুণ। মানুষের চরিত্র গঠনে এটি বিরাট প্রভাব ফেলে। এটি মানব জীবনের সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। এটি মানুষের মধ্যে এমন এক নৈতিক শক্তি গড়ে তোলে যার ফলে সে ন্যায়-অন্যায় বিচার করে চলতে পারে। এর বদৌলতে মানুষ স্বার্থপরতা মুক্ত হয় এবং তার মধ্যে অপরকে সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হয়। ছাত্রজীবনের একটি প্রধান কর্তব্য হলো এই আত্মনিয়ন্ত্রণকে আয়ত্ত করা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন