বৃহস্পতিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২১

আত্মশুদ্ধিতে প্রয়োজন বিবেকবোধের জাগরণ


রমজান মাস হলো আত্মশুদ্ধির সাধনার মাস


মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভাল-মন্দ বুঝার একটি স্বাভাবিক বোধ বা বিবেক আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন। এই বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত। বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি সব সময়ই মানুষের সৎ বৃত্তির বিকাশ কামনা করে, মানুষকে সৎ পথে চালিত করে। এ বোধ বা বিবেককে কেউ কেউ নীতিবোধ বা চৈতন্যও বলেছেন। ইসলাম এরই নাম দিয়েছে ক্বালব, অন্তর বা হৃদয়। মানুষ যখন খারাপ কাজ করে তখন তার বিবেক তাকে দংশন করে। আর যখন ভালো কাজ করে তখন বিবেক স্বস্তি পায়। মহানবী (সঃ) বলেছেন – “যে কাজে তোমার মন স্থিতি লাভ করে এবং যে কাজে হৃদয় বা বিবেক স্বস্তি ও নিশ্চয়তা পায় তাই পূণ্য বা সুনীতি। পক্ষান্তরে যে কাজে তোমার মন স্থিরতা পায় না এবং বিবেক স্বস্তি পায় না তাই পাপ বা দুর্নীতি।”

মানুষের প্রকৃতি বা নফসের মধ্যে এই বিবেকবোধ আল্লাহই দিয়ে দিয়েছেন। যেমন সূরা আশ্ শামস্ -এ বলা হয়েছে : ‘কসম মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির) এবং কসম সেই সত্তার যিনি তাকে সঠিকভাবে গঠন করেছেন, তারপর তার উপর পাপ ও নৈতিক বোধ ইলহাম করেছেন।’ [সূরা আশ শামস : ৭-৮]

আল কোরআনে মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির ) তিনটি রূপের কথা বলা হয়েছে। একটি নফস হল যা মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও দুস্কৃতির কাজে উস্কানি দেয়। একে বলা হয় ‘নফসে আম্মারা’। দ্বিতীয় ধরনের নফস হল যা ভুল বা অন্যায় কাজ করলে, অন্যায় ও ভুল কথা চিন্তা করলে বা খারাপ নিয়ত বা মন-মানসিকতা পোষণ করলে মানুষকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করে, ভিতর থেকে মানুষকে তিরষ্কার করে। এর নাম হল ‘নফসে লাউয়ামা’। আমরা একে ‘বিবেক’ও বলতে পারি। তৃতীয় হল সেই নফস, যা সত্য-সঠিক পথে চলা ও ভুল বা অন্যায় পথ পরিহার করার দরুন অন্তরে স্বস্তি ও নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। এর নাম হলো ‘নফসে মুতমায়িন্না’।

মানুষের প্রতি তার পাপ এবং তার নেকী ও তাকওয়া ইলহাম করে দেয়ার দুটি অর্থ হয়। এক, স্রষ্টা তার মধ্যে নেকী ও গোনাহ উভয়ের ঝোঁক প্রবণতা রেখে দিয়েছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিই এটি অনুভব করে। দুই, প্রত্যেক ব্যক্তির অবচেতন মনে আল্লাহ এ চিন্তাটি রেখে দিয়েছেন যে, নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোন্ জিনিস ভাল এবং কোন জিনিস মন্দ এবং সৎ নৈতিক বৃত্তি ও সৎকাজ এবং অসৎ নৈতিক বৃত্তি ও অসৎকাজ সমান নয়। ফুজুর (দুস্কৃতি ও পাপ) একটি খারাপ কাজ এবং তাকওয়া (খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা) একটি ভাল কাজ, এ চিন্তাধারা মানুষের মধ্যে নতুন নয়।

বস্তুবাদী দর্শন মানুষকে শুধুমাত্র জৈববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমষ্টি মনে করলেও ইসলাম তা মনে করে না। শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই মানুষ ইতরতার উর্ধ্বে উঠতে পারে না। বরং বুদ্ধির জোরে মানুষ এমন উম্মত্ত ও পাশবিক আচরণও করতে পারে যা কোন ইতর প্রাণীর পক্ষেও সম্ভব হয় না। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের প্রধান পরিচয় হল তার নৈতিক সত্তায়। অর্থাৎ, যে সত্তাটি মানুষকে ইতর প্রাণী থেকে পৃথক ক’রে তাকে স্বাতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে তা তার নৈতিকতা বা বিবেক। জন্মগতভাবেই আল্লাহ মানুষের ফিতরাৎ বা স্বভাব-প্রকৃতিতে এটি দিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন -‘আর না, আমি কসম করছি (মানুষের মধ্যেকার) নফসে লাওয়ামার (বিবেক) যা তাকে তিরষ্কার করে।-[আল কিয়ামাহ : ২]

মানুষের এই নৈতিকতা, বিবেক বা চরিত্রেরই অপর নাম হল মনুষ্যত্ব। মনুষষ্যত্ব বা বিবেকবোধের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত। কিন্তু মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেলে মানুষের সবই হারিয়ে যায়। তখন তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না বরং তার চেয়েও নীচে নেমে যায়। এ কথাটিই সূরা আত্ তীনে এভাবে বলা হয়েছে :

‘আমি মানুষকে তৈরি করেছি সর্বোত্তম কাঠামোয়। আবার তাকে ফিরিয়ে নীচতমদেরও নীচে পৌছে দিয়েছি। তাদেরকে ছাড়া; যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করতে থাকে।’ [৪-৫]

মানব সত্তার এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই পৃথিবীতে মানুষের পথ আর অন্যান্য মানবেতর প্রাণীর পথের মত হতে পারে না। মানুষের জীবনোপকরণ, তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনও তাই নিছক অন্য সব প্রাণীর মত শুধুমাত্র বস্তুগত ও জৈবিক চাহিদার মধ্যেই সীমিত থাকতে পারে না। মানুষ যেহেতু বোধহীন নয়, সেহেতু তার জীবনও অন্যান ইতর ও অবোধ প্রাণীর মত গতানুগতিক, উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না। বরং যেহেতু মানুষকে ঘোষণা করা কয়েছে খোদার খলিফা, যেহেতু তাকে দেয়া হয়েছে বুদ্ধি-বিবেক ও একটি উন্নত নৈতিক সত্তা সেহেতু পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজনেও পরম করুণাময়ের রয়েছে একটি বিশেষ আয়োজন। ধর্ম সেই প্রয়োজন পূরণেরই অনিবার্য দাবী।

ইসলাম তাই মানুষের এই মনুষ্যত্ব বা বিবেকের পূর্ণ বিকাশ চায়। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন বলেছেন :‘নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে সে ব্যক্তি যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করেছে আর ব্যর্থ হয়েছে সে ব্যক্তি -যে তাকে দাবিয়ে রেখেছে।’[আশ্শামস:৯-১০]’ ; ‘সফল হয়েছে সে ব্যক্তি যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে।’ -[আ’লা : ৪]

মহানবী (সঃ) বলেছেন: ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি আবির্ভূত হয়েছি।’

“হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই একজন মুমিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রগুণে সেসব আবেদ লোকের মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত নামাযে কাটায় আর সারা বছরই রোযা রাখে।” -[আবু দাউদ]

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে উত্তম, যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।” -[বুখারী, মুসলিম]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন