বুধবার, ১২ মে, ২০২১

মহামারীতে জীবন ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় সমাজসেবা: ব্যাস্টিক ও সামস্টিক উদ্যোগ



‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে।এমনকি তোমরা কবর পর্যন্ত পৌছে যাও।’’ -সূরা তাক্বাসুর, আয়াত: ১-২

দিন দিন মানুষের জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে।সেই সাথে বাড়ছে কর্মহীনতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। এই দ্বিমুখি অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে সমাজ সেবা এবং তার জন্য ব্যাস্টিক ও সামস্টিক উদ্যোগের প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরের একটু বেশি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে,  আমাদের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর।এর মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছরই চলে যায় ক্যারিয়ার গঠনের পেছনে।গড়ে আমাদের কর্মজীবন শুরু হয় ত্রিশ বছর বয়স থেকে।আর গড়ে আমাদের জীবনে বার্ধক্য বা অবসরে যাওয়ার সময় চলে আসে ৬০ বছর বয়সেই।তাই বলা যায়, আমরা মূলতঃ ভালভাবে কাজ করার সময় পাই ত্রিশ থেকে ৩৫ বছর।আর এই ৩০-৩৫ বছরের কর্মজীবনে আমরা যত কাজ করি তার প্রায় পুরোটাই দুনিয়ার জন্য।অর্থাৎ পার্থিব জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করার সংগ্রাম করতে করতেই আমাদের কবরে চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়।অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের বিত্ত-বৈভব, বাড়ি-গাড়ী, ব্যাংক-ব্যালেন্স, সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্যই আমরা যতটা ব্যাতি-ব্যস্ত থাকি; এজন্য যতটা সময় ব্যস্ত থাকি তার একশো ভাগের এক ভাগও আমরা আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য ভাবি না বা এ বিষয়টি আমাদের স্মরণেই আসে না।অথচ আখেরাতের জীবনের তুলনায় আমাদের এই পার্থিব জীবন নিতান্তই তুচ্ছ।আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের নগণ্যতা বুঝাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, পরকালের তুলনায় দুনিয়ার উপমা শুধু এতটুকুই যেমন তোমাদের মাঝে কেউ নিজের একটি অঙ্গুলি সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে তুলে নিল। অতঃপর দেখ তাতে কতটুকু পানি লেগে এসেছে।’ -সহিহ মুসলিম শরিফ।

আসলে পরকালের জীবনই আসল জীবন। যে জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।অথচ আখেরাতের সেই অনন্ত জীবনের জন্য ভাবনার সময় আমাদের নেই।আমরা রাত-দিন দুনিয়ার পিছনেই ছুটছি। এমনকি সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে আমরা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াই তখনও আল্লাহকে আমরা খুব কমই স্মরণ করি, নামাজের মধ্যেও দুনিয়ার চিন্তাই আমাদেরকে অস্থির করে রাখে।আর এই দুনিয়ার ধান্দা করতে করতেই যখন আমাদের প্রভূর কাছে ফিরে যাওয়ার ডাক আসে তখন দুনিয়ার এই সব বিত্ত-বৈভব সব কিছু মাটির উপরে রেখে আমাদেরকে মাটির নীচে চলে যেতে হয়।তখন দুনিয়ার কিছুই আমাদের সাথে যায় না, যায় শুধু আমাদের আমল।নেক বা বদ যে আমলই আমরা দুনিয়ায় করেছি তাই আমাদের সাথে যাবে। এ কারণেই বলা হয় ‘দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।’ এখানে যে আমল আমরা করেছি আখেরাতের অনন্ত জীবনে তাই আমাদের ভোগ করতে হবে।

আসলে দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগী আখেরাতের অনন্ত জীন্দেগীর কামিয়াবির জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র মাত্র।আর মৃত্যুর মাধ্যমে এই পরীক্ষা ও মানুষের দুনিয়ার জিন্দেগীর অবসান ঘটে।পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে গেলে যেমন আর উত্তর লেখার সুযোগ থাকে না, তেমনি মৃত্যু এসে গেলে আর আমলের সুযোগ থাকে না।মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুনিয়ার জীন্দেগীর অবসান হয় এবং একই সাথে আখেরাতের অনন্ত জীবনের যাত্রা শুরু হয়।

সদকায়ে জারিয়া

তবে এমন কিছু আমল আছে, যা জীবদ্দশায় করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব ও উপকারিতার ধারা অব্যাহত থাকে। এগুলোকে সদকায়ে জারিয়া বলে।

‘সদকা’ শব্দের অর্থ দান করা। আর ‘জারিয়া’ অর্থ অব্যাহত। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে সমাজ ও মানুষের কল্যাণে এমন কাজ করে যাওয়া যা ব্যক্তির মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।

সদকায়ে জারিয়ার কারণে মৃত্যুর পরও দানকারীর ‘সওয়াব সঞ্চয়’ সমৃদ্ধ হতে থাকে। এর স্রোতধারা তার ‘পুণ্য তরি’কে চলমান রাখে। এটা আল্লাহতায়ালার বিশেষ নিয়ামত ও রহমত। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমলের ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট কিছু আমল করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব জারি থাকে। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের জন্য সওয়াব পৌঁছার ব্যবস্থা করে যেতে পারে এবং চাইলে তার জারি করা ভাল কাজের কারণে উপকারভোগী অন্য মানুষের মাধ্যমেও তার নেক আমলের পাল্লা ভারি হতে পারে।এ উভয় পদ্ধতিই আল্লাহতায়ালার একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সেবা বা সদকায়ে জারিয়ার গুরুত্ব

আমরা যত ইবাদত-বন্দেগী করি তার কতটা শুদ্ধ বা ত্রুটিমু্ক্তভাবে করতে পারি? এই যে পবিত্র রমজান মাস আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিল আমরা কতটা এই মাসের হক আদায় করতে পেরেছি? কতটা সময় আমরা আল্লাহকে স্মরণ করেছি আর কতটা সময় মোবাইল, গেম, বিনোদনের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি? যে রমজান ছিল পবিত্র কুরআন মজিদ নাযিলের মাস, সেই পবিত্র কুরআনকে আমরা কতটা অন্তরে ধারণ করতে পেরেছি? কুরআন মজিদকে আমরা কতটুকু বুঝতে পেরেছি? আমাদের দেশে তারাবীর নামাজে যেভাবে ‍কুরআন তেলাওয়াত করা হয় তা আমাদের হৃদয়ে কতটা রেখাপাত করতে পারে? আল্লাহর রাসূল বলেছেন, যারা মিথ্যা কথা আর অন্যায় কাজ থেকে বিরত হতে পারলো না তাদের পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। পবিত্র এই মাস ছিল আত্মসংযম ও আত্মিক উন্নতির এবং আল্লাহকে ভয় করে চলার এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণের মাস, যাতে আমরা বাকি এগারোটি মাসও আল্লাহকে ভয় করে চলতে পারি; কিন্তু আমরা এই প্রশিক্ষণ কতটুকু নিয়েছি, রমজানের তাৎপর্য উপলব্ধি করে এর হক আদায় করে আমরা কতটা সিয়াম সাধনা করতে পেরেছি? যদি পারতাম তাহলে এই পবিত্র মাসে কেন দ্রব্যমূল্য হু হু করে বৃদ্ধি পায়? এই পবিত্র মাসে যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও দান-সদকার অনেক ফযিলতের কথা বলা হয়েছে।যাকাত তো ফরজ ইবাদত। আমরা কি যথাযথভাবে হিসাব করে সঠিকভাবে যাকাত আদায় করি? এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে আমাদের প্রতিটি ইবাদতের মধ্যেই অনেক ত্রুটি, গাফলতি, অপূর্ণতা থেকে যায় এবং এই ত্রুটিপূর্ণ আমল নিয়েই আমরা আমাদের ত্রিশ/পয়ত্রিম বছরের কর্মজীবনের অবসান ঘটিয়ে কবরে পৌঁছে যাই। পরকালের অনন্ত জীবনে আমাদের এই স্বল্প সময়ের ত্রুটিপূর্ণ ও মানহীন আমল নিয়ে আমরা কতটা পার পাবো সেটাই চিন্তার বিষয়।

বলাবাহুল্য সৃষ্টিকর্তা মানুষের এই দুর্বলতার কথা ভাল করেই জানেন। আর সেকারণেই মানুষের এই আমলের ঘাটতি পূরণের জন্যই ইসলামে সদকায়ে জারিয়ার বিধান দেয়া হয়েছে। সদকায়ে জারিয়ার এই আমলের কল্যাণে একদিকে যেমন ৭২ বছরের গড় আয়ুর মানুষ মৃত্যুর পরও আরও শত শত বছর নেক আমলের সুযোগ লাভ করে তার  ব্যক্তিগত আমলের রেকর্ডকে সমৃদ্ধ করতে পারে, তেমনি সামষ্টিকভাবে মানবতার কল্যাণও নিশ্চিত হয়।কেননা, ইসলাম মানবতার ধর্ম, মানবসেবার ধর্ম। ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের ও সকল জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ এক আদমের সন্তান এবং তারা সকলে মূলত এক জাতি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল ঘোষণা করেছেন :

‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তিনি সকল বিষয়ে অবহিত।’-[আল হুজরাত : ১৩]

আমাদের আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও মা হজরত হাওয়া আলাইহিস সালাম হতে আমাদের মানবকূলের বংশ বিস্তৃত। সে হিসেবে আমরা প্রত্যেকে একজন আরেকজনের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জড়িত। 

মহানবীর মিশনের চূড়ান্ত লক্ষও ছিল সারা বিশ্বের মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা বা মানবতার কল্যাণ। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বজাহানের জন্য আল্লাহর রহমত।আল্লাহ বলেন, 

“আর আমি তো তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।”-[আল আম্বিয়া : ১০৭]

মুসলিম উম্মাহর অন্যতম মিশনও ছিল মানবতার কল্যাণ।আর এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন মুসলিম উম্মাহকে দিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের সনদ।পবিত্র কালামে মজিদে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানব জাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদেরকে আবির্ভূত করা হয়েছে। - সূরা আল ইমরান, আয়াত ১১০

মানব সেবায় ইসলাম এতো উৎসাহ দিয়েছে যে, রাস্তা ও চলার পথে মানুষের জন্য কষ্টদায়ক সামান্য পাথর সরিয়ে ফেলাকে মহৎ কাজ হিসেব গণ্য করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ইমানের ৭২টি শাখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো রাস্তা থেকে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া।’ (মুসলিম শরিফ)।

মানুষের জন্যে যার মনে কোনো দয়া নেই আল্লাহ তায়ালার রহমতও তার ওপর নেই। হাদিস শরীফে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে না আল্লাহও তার প্রতি রহমত করেন না।’ (তিরমিযী শরীফ)।

আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ২৬১ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শিষ, প্রতিটি শিষে রয়েছে ১০০ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান, তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’  গরীব, দুঃখী, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করলে একটি সমাজ সুন্দর হয়ে ওঠে। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে কখনো কোনো সাহায্য প্রার্থীকে না বলেননি। 

এ কারণেই মুসলিম সমাজের শক্তি ও ঐক্যের মূলমন্ত্রই হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। যেখানে একে অন্যের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসা, সাহায্য-সহযোগিতা করা, গরীব-অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করা পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব বলে গণ্য করা হয়।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্টসমূহ থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে কিয়ামতের কষ্টসমূহ থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেবে আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’ (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)।

বিদায় হজে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আজকের এ মহান ইয়ামুন্নাহারের দিনে, এ পবিত্র জিলহজ মাসে এ পবিত্র হেরেম শরিফে তোমাদের তথা প্রতিটি মুসলমানের  জান, মাল, সম্পত্তি, ইজ্জত, শরীরের চামড়া যেভাবে হারাম ও সুরক্ষিত, ঠিক তেমনিভাবে সব দিন, সব মাস ও সর্ব স্থানে হারাম ও সুরক্ষিত বলে গণ্য হবে। খবরদার! তোমরা আমার অবর্তমানে পুনরায় কাফেরদের ন্যায় পরস্পর মারামারি, কাটাকাটিতে লিপ্ত হবে না।’ (বুখারি শরিফ)।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত কর, দরিদ্রকে খাদ্য দান কর এবং উচ্চ শব্দে সালাম কর। নিরাপত্তা সহকারে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ এই ছিল মহানবী (সা.) এর শিক্ষা। মহানবী আমাদের ভোগ বিলাস ত্যাগ করে অন্যের সাহায্যে নিজেকে নিয়োজিত করার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন। অসহায়কে সাহায্য করাকে নবীজি (সা.) জিহাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার ধারণা তিনি আরো বলেন, ‘এবং সে ওই সালাত আদায়কারীর ন্যায় যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায় যার সিয়ামে বিরত নেই।’ (সহিহ বোখারি,সহিহ মুসলিম)।

হজরত আবু হুরায়রা ( রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রূষা করোনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক। আপনিতো বিশ্বপালনকর্তা কীভাবে আমি আপনার শুশ্রূষা করব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কী জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তাকে তুমি দেখতে যাওনি। তুমি কী জান না, যদি তুমি তার শুশ্রূষা করতে তবে তুমি তার কাছেই আমাকে পেতে।’ ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে আহার করাওনি।?’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব, তুমি হলে বিশ্ব পালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কী জান না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি খাদ্য দাওনি। তুমি কি জান না যে, তুমি যদি তাকে আহার করাতে তবে আজ তা প্রাপ্ত হতে।?’ ‘হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন তোমাকে আমি কীভাবে পান করাব?’ তিনি বলবেন, ‘তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল কিন্তু তাকে তুমি পান করাওনি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা প্রাপ্ত হতে।’ (মুসলিম : ৬৭২১; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭৩৬)

সুতরাং আমাদের উচিত সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় গরীব, অসহায় মানুষকে সাহায্য করা, মানব কল্যাণে অবদান রাখা।তাহলে একদিকে যেমন মানব সমাজে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হবে, অন্যদিকে আল্লাহর নৈকট্য লাভও সহজ হবে।

মানব সেবায় সামাজিক সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের গুরুত্ব

কথায় আছে: 

দশের লাঠি একের বোঝা,
দশে মিললে কাজ সোজা।

আমরা অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে দান বা সদকাহ করে থাকি। তবে ব্যক্তির সক্ষমতার সব সময়ই একটি সীমা থাকে। আবার সব ব্যক্তির সামর্থও একরকম থাকে না। সামর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ব্যক্তির মধ্যে জনসেবার মানসিকতা ও মেধা থাকা সত্ত্বে তারা তা কাজে লাগাতে পারেন না, যা সমবেত উদ্যোগের মাধ্যমে সহজেই করা যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, দানশীল ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার তৎপরতারও অবসান হয়।অবশ্য তিনি যদি মানবসেবার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান রেখে যান তখন তা দীর্ঘ সময় টিকে থাকে।

তাই সকলের সীমিত সামর্থ ও উদ্যোগের সমবায়ে সহজেই একটি বৃহত্তর সক্ষমতা গড়ে তোলা যায় যা সামাজিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাপক ব্যাপ্তি নিয়ে কাজ করতে পারে, যেখানে সকলেই নিজ নিজ সামর্থ ও মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পায়।

আবার সামাজিক সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন নতুন দানশীল ব্যক্তি, সংগঠক ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও সম্ভব হয় যার মাধ্যমে সৎকাজ বা নেক আমলের একটি ধারাবাহিকতাও জারি থাকে।

ভাল কাজ করার জন্য আপনার সদিচ্ছাই যথেষ্ট

আপনি হয়তো চান আপনার পিতা-মাতার নামে বা আপনার নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন করবেন; যার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তার, দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া যাবে। কিংবা অসহায় এতিম নারী ও শিশুদের পুনর্বাসন ও বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও মাদকাসক্তদের পুণর্বাসন করা হবে।আর এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ফান্ড বা তহবিল গঠন করা। এখানে মূলত আমরা এ বিষয়টি নিয়েই কথা বলবো। যাদের পর্যাপ্ত এককালীন ফান্ড নাই কিন্তু ইচ্ছা আছে, তাদের সামনে প্রচলিত উপায় হলো ২টিঃ ১. লোন করা, ২. সঞ্চয় করা।

লোন করলে তা শোধ করার একটা দায় থাকে। লোন শোধ করার আগে যদি মৃত্যু হয় তাহলে আরেক বিপদ। লোন নিয়ে মারা গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এখন আসি সঞ্চয়ের কথায়। প্রথমত, ব্যাংকে দীর্ঘ মেয়াদে ডিপিএস করা যায়। যেমনঃ ১০, ১৫ বা ২০ বছর। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদের ডিপিএস করলে কিস্তির টাকার পরিমান কম ও সহনিয় হয়।প্রফিটও বেশি হয়। কিন্তু ব্যাংকে এত দীর্ঘ মেয়াদের ডিপিএস করলে আপনাকে অবশ্যই মেয়াদ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে। কারন, মেয়াদ পূরতির আগে মারা গেলে আপনার কাংখিত মূলধন গঠন হবেনা এবং আপনার সপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।

সঞ্চয়ের আরেকটি মাধ্যম হলো লাইফ ইন্সুইরেন্স।লাইফ ইন্সুইরেন্স-এ দীর্ঘ মেয়াদের ডিপিএস বা মেয়াদি বীমার সুযোগ রয়েছে যেখানে আপনি মাসিক, ষান্মাসিক কিংবা বাৎষরিক কিস্তিতে টাকা জমা দিতে পারেন। ইন্সুইরেন্সে সুবিধা হলো, মেয়াদ শেষে আপনি তো প্রফিটসহ আপনার আমানতের টাকা ফেরত পাবেন; যা দিয়ে আপনি নিজেই একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান করতে পারবেন যা আপনার মৃত্যুর পরও সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কাজ করবে।আবার (আল্লাহ না করুন) মেয়াদ পূরতির আগে মারা গেলেও আপনার সপ্ন পূর্ণ হতে কোন বাধা থাকবে না। কারণ, সেক্ষেত্রে কোম্পানি আপনার নোমনীকে পূর্ণ মেয়াদের টাকা প্রফিটসহ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।আপনি যদি ২০ বছর মেয়াদী বীমা করে মাত্র একটি কিস্তি দিয়েও মারা যান বা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান তাহলেও কোম্পানী আপনার মোনোনীত নোমিনীকে (ব্যক্তি বা প্রতিসঠান) পূর্ণ মেয়াদের বীমা দাবির টাকা প্রদান করবে যারা আপনার ওসিয়ত অনুসারে মানব সেবা বা শিক্ষা বিস্তারের জন্য কোন ফাউন্ডেশন বা প্রতিসঠান করতে পারবেন যার সওয়াব সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আপনার আমলনামায় যোগ হতে থাকবে। 

তবে ব্যাংক হোক কিংবা লাইফ ইন্স্যুরেন্স- উভয়ের ক্ষেত্রেই শর্ত হোলো, কোম্পানিটিকে অবশ্যই সূদমুক্ত ইসলামী প্রতিষ্ঠান হতে হবে।কারণ, সূদের টাকায় ইসলামী প্রতিষ্ঠান করা যায় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন