শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২১

মহানবীর আদর্শ বনাম ভোগবাদ


রাসূল (স.) যে সময়কালে আবির্ভূত হয়েছিলেন সে সময় মানুষ ছিল চরম ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও ভোগবাদের মধ্যে আচ্ছন্ন। দুনিয়ার মোহ সে সময়ের মানুষগুলোকে বিবেকহীন অন্ধ ও পশুজীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তারা ছিল ভয়ানকভাবে অপরাধ প্রবণ। আখেরাতের জীবন সম্পর্কে তারা ছিল চরমভাবে গাফেল। ধর্মীয়জীবনে নানুমুখী বিকৃতির কারণে এ সম্পর্কে বিশুদ্ধ কোন ধারনা তাদের মধ্যে ছিল না। ইহুদি আলেম ও পীর পুরোহিতরা নিজেদের ধর্ম ব্যবসায়কে টিকিয়ে রাখার জন্য আখেরাতের জীবন সম্পর্কে মনগড়া সব কিচ্ছা-কাহিনী ফেঁদে বসেছিল। আল্লাহর কাছে জবাবদিহীতার পরিবর্তে এসব পীর-পুরোহিতদেরকে সন্তুষ্ট করার মধ্যেই মানুষ আখেরাতে নাজাতের উসিলা পেয়ে যেতো। তারা হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের পরকালীন জিন্দেগীর জিম্মাদার।

এসব বিভ্রান্ত ধর্মীয় নেতারা সামান্য নজর-নিয়াজ ও প্রাপ্তিযোগের বিনিময়ে লোকদের পরকালীন জীবনের সফলতার গ্যারান্টি দিত। ফলে সে সময়ের মানুষগুলো হয়ে উঠেছিল চরমভাবে স্বেচ্ছাচারী। এ অবস্থায় নবী করিম (স.)-এর অন্যতম প্রধান কাজ ছিল আখেরাত সম্পর্কে বিশুদ্ধ ধারণা প্রচার এবং সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও যতœবান করে তোলা। আখেরাতের সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে সুসংবাদ প্রদান ও ভীতি প্রদান করা ছিল নবী-রাসূলদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব বা মিশন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:

‘সকল মানুষ একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তখন আল্লাহ তা’য়ালা নবী পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে। আর তাদের সাথে অবতীর্ণ করলেন সত্য কিতাব, যেন মানুষের মধ্যে বিতর্কিত বিষয়ের মীমাংসা করা যায়।’ [বাকারা : ২১৩]

মহানবীর মিশন সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলে দিচ্ছেন এভাবে:

‘হে নবী, আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীদাতা, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে এবং খোদার অনুমতিক্রমে তাঁর প্রতি আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে।’ -[আল-আহযাব : ৪৫]

বস্তুত আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস ইসলামী জীবনবোধের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ। অথচ তাওহীদের মত আখেরাত বা পরকালীন জীবন এবং আল্লাহর কাছে পার্থিব জীবন সম্পর্কে জবাবদিহীর ব্যাপারেও সঠিক ও বিশুদ্ধ ধারণা সে সময়ের মানুষ হারিয়ে ফেলেছিল।

এখন যেমন বস্তুবাদী ও সেকুলার ভিত্তিক ভোগবাদী জীবন-দর্শন মানুষের জীবন-দৃষ্টিকে শুধুমাত্র পার্থিবতার দিকেই আটকে দেয় তখনকার মানুষেরও জীবনবোধ একই রকম ছিল। তারা ছিল চরম ভোগবাদি। ভোগ করার মধ্যেই তারা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেতো। মৃত্যুর পরে আদৌ কোন জীবন আছে কিনা সে সম্পর্কে তাদের ছিল ঘোরতর সন্দেহ। আবার ইহুদী-খৃস্টানসহ তৎকালীন ধর্মীয় গোষ্ঠী সমূহের মধ্যে পরকালীন জীবনের জবাবদিহীতা এবং সেখানকার সফলতা ও ব্যর্থতার বিষয়ে তখনও যৎ সামান্য যে ধারণা বিদ্যমান ছিল, তাতেও ছিল নানা রকম ভিত্তিহীন ও মনগড়া ধারণা-বিশ্বাসের মিশেল। অথচ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ভিত্তিহীন ধারণা-বিশ্বাসের কারণেই মানুষের জীবনপথ ভুল পথে পরিচালিত করতে হয়।

আমাদের চারপাশের এই দৃশ্যমান জগতের বাইরেও যে সুবিশাল জগৎ রয়ে গেছে সেটি আপাত আমাদের জ্ঞান ও বোধগম্যতার বাইরে থাকার কারণে প্রচলিত বস্তুগত জ্ঞান সেই দূরবর্তী জীবন বা পরজীবন সম্পর্কে বলা যায় অজ্ঞ এবং বস্তুগত জ্ঞান পরকালের মহাজীবনের সাথে আমাদের বর্তমান জীবনের সম্পর্কের কোন তাৎপর্যও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বস্তুবাদী জীবন-দর্শন অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত। কিন্তু ইসলাম পৃথিবীবাসীকে যে জীবন-দর্শন উপহার দেয় তা বস্তু-পৃথিবী ও দৃশ্যমান জীবন ও জগতের সীমানা ভেদ করে আমাদের বস্তুগত জ্ঞান, কল্পনা ও বোধগম্যতার বাইরের এক মহাজগতের সন্ধান দেয়। ইসলামী জীবনদৃষ্টি পৃথিবীকে ভেদ করে স্রষ্টার কাছে চলে যায়। জীবনবোধের এই বিশালত্ব ও সম্পূর্ণতার কারণে ইসলামী জীবন-দর্শন সকল ধরনের কুপমণ্ডুকতা ও সংকীর্ণ বস্তুবাদী-ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অভিশাপ থেকে মুক্ত। আর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) সহ সব নবী-রাসূলগণ ছিলেন আখেরাতমুখি এই সম্পূর্ণ ও সুবিশাল জীবনদৃষ্টির প্রবক্তা।

আমাদের এই পৃথিবী গ্রহের চব্বিশ ঘন্টায় একদিন হিসেবে যে ক’দিন আমরা বাঁচি, তা মহাকাশের তথা পরকালের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ ও নগণ্য। পরকালের তুলনায় দুনিয়াটা হচ্ছে নিছক বাচ্চাদের খেল-তামাশার মত। দুনিয়ার এই চাকচিক্য ও মোহ খুবই ক্ষণস্থায়ী। আমাদের জীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি পৃথিবীর এই বসন্ত, এই অপরূপ সৌন্দর্যও অস্থায়ী। একদিন মঙ্গলগ্রহের মতই পৃথিবী বৃক্ষহীন হবে, তার সব সৌন্দর্য ও শ্যামলিমা হারিয়ে প্রাণহীন নিরস-নিস্ফলা মৃত্তিকায় পরিণত হবে। যেমন আল কোরআনে বলা হয়েছে:

‘তাদের কাছে এই দুনিয়ার উদাহরণটি বর্ণনা করে দাও। তা পানির মত, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি। অতপর এর সংমিশ্রণে শ্যামল-সবুজ ভূমিজ লতা-পাতা উৎপণœ হয়। তারপর তা শুকিয়ে এমন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় যে, সামান্য বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সবকিছুর উপর শক্তিমান।’-[আল কাহফ : ৪৫]

‘আমি পৃথিবীর মধ্যকার সকল কিছুকেই দৃষ্টিনন্দন করে সৃষ্টি করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করতে পারি, তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে। পৃথিবীতে যা কিছু আছে, একদিন আমি উদ্ভিদশূন্য মাটিতে পরিণত দিব।’-[আল কাহফ : ৭-৮]

একদিন আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রচ- শব্দে শুরু হবে প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প এবং তাতে সমস্ত সৃষ্টি লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। একে বলা হয় কিয়ামত বা মহাপ্রলয়। পবিত্র কোরআন মজিদে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে :

‘যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, একটি মাত্র ফুঁ এবং পৃথিবী ও পর্বতমালাকে উঠিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হবে, সেদিন কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে।’-[আল হাক্কাহ : ১০-১৩]

‘যখন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে তখন আসমান ও জমিনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন সে ব্যাতীত। অতপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, তখন তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে।’-[আয যুমার : ৬৮]

এরপর সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে এক নতুন জগতে উপস্থিত করাবেন যাকে বলা হয় হাশরের ময়দান। সেখানে প্রত্যেক মানুষের দুনিয়াবী জিন্দেগীর আমলের হিসেব-নিকেশ করা হবে :

‘তা এমন একটি দিন, যেদিন সমস্ত মানুষ সমবেত হবে। সেদিনটি যে উপস্থিত হবার দিন।-[হূদ : ১০৩]

‘যেদিন তারা বের হয়ে পড়বে, আল্লাহর কাছে তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। আজ রাজত্ব কার? প্রবল পরাক্রান্ত আল্লাহর’-[মু’মিন : ১২]

সেদিন মানুষের দুনিয়ার বাহাদুরী আর থাকবে না। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন সমস্ত কর্তৃত্ব গ্রহণ এবং মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিবেন। সেদিন কেউ কারো কোন উপকারে আসবে না। সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহর ফায়সালাই হবে চূড়ান্ত।

দুনিয়ায় যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলেছে তারা সেদিন সফল হবে, তাদের জন্য কোন ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না, তারা হবে সৌভাগ্যবান। আর যারা দুনিয়ায় বেপরোয়া জীবন-যাপন করেছে, সেদিন তারা চরমভাবে ব্যর্থ হবে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে চরম অপমান আর দুঃখ। বস্তুত তাদের মত হতভাগ্য সেদিন আর কেউ হবে না। পবিত্র কালামে বলা হয়েছে :

‘সেদিনটি এলে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। তাদের কিছু লোক হবে হতভাগ্য এবং কিছু লোক হবে সৌভাগ্যবান। যারা হতভাগ্য তারা জাহান্নামে যাবে, সেখানে তারা আর্তনাদ ও চিৎকার করতে থাকবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, যতদিন আসমান-জমিন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্যকিছু ইচ্ছে করলে ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা যা ইচ্ছে করতে পারেন। আর যারা সৌভাগ্যবান তারা জান্নাতে যাবে। সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে, যতদিন আসমান-জমিন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক যদি অন্যকিছু ইচ্ছে পোষণ করেন তা ভিন্ন কথা। এ দানের ধারাবাহিকতা কখনও ছিন্ন হবার নয়।’-[হূদ : ১০৫-১০৮]

মানুষের জীবনে আখেরাতের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রভাব অপরিসীম। আখেরাতের উপর যথাযথ ও দৃঢ় বিশ্বাস মানুষের জীবন-প্রবাহকে একদিকে প্রবাহিত করে আর আখেরাতে অবিশ্বাস মানুষের জীবনধারাকে পরিচালিত করে ভিন্ন দিকে। ইসলামী জীবনধারায় তাই আখেরাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আখেরাত তথা আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি ঈমান্দার-মুসলমানদেরকে পৃথিবীতে দায়িত্বানুভূতি সম্পন্ন মানুষে পরিণত করে এবং তাদের জীবনধারাকে পরিচালিত করে একটি সুনিয়ন্ত্রিত ধারায়।

একজন আখেরাত বিশ্বাসী মানুষ কখনও বল্গাহীন, অনিয়ন্ত্রিত ও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে পারে না। একজন সত্যিকার মুমিন-মুসলমান কখনো আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে পারে না।

সুতরাং একটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের প্রয়োজনে সর্ব প্রথম সমাজের মানুষকে আখেরাতমুখী করে তোলা অপরিহার্য। আখেরাতের প্রতি প্রবল ঈমান ছাড়া কারো পক্ষে ঈমান্দারীর পথে এক কদম অগ্রসর হওয়াও সম্ভব নয়। কারণ মানুষের জীবনদৃষ্টি যতক্ষণ পর্যন্ত আখেরাত পর্যন্ত প্রসারিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে দুনিয়ার মোহ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না; তার দৃষ্টি বৈষয়িকতার সীমার মধ্যেই আটকে থাকবে। দুনিয়া পাওয়ার ধান্দাই তাকে সারাক্ষণ মশগুল রাখবে :

‘দুনিয়ায় একে অন্য থেকে বেশি পাওয়ার ধান্দাই তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে। এমনকি (ধান্দাবাজি করতে করতেই) তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। কখখনো না, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবার (শুনে নাও), কখখনো না, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। কখখনো না, যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে (এই আচরণের পরিণাম) জানতে! (তাহলে তোমরা এ ধরনের কাজ করতে না)। নিশ্চয়ই তোমরা জাহান্নাম দেখতে পাবে। আবার (শুনে নাও), একেবারে স্থির, নিশ্চিতভাবেই তোমরা তা দেখতে পাবে। তারপর নিশ্চয়ই সেদিন তোমাদেরকে (দুনিয়ার) এই নিয়ামতগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ -[তাকাসুর]

‘যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং অহংকারী।’-[নাহল :২২]

‘যে আখেরাতকে বিশ্বাস করে না, সে সরল রাস্তা থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়ে।’-[আল মু’মিনূন : ৭৪]

আখেরাতের প্রতি কারো ঈমান যদি দুর্বল হয়, তাহলে তার আল্লাহ, রাসূল, ফিরিশতা, কোরআনের প্রতি ঈমান ও ইসলামী সমস্ত বিধি-বিধানও তার কাছে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এবং তারা যদি আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনারও দাবী করে তাহলেও তারা ঈমান্দার হতে পারবে না। কারণ আল্লাহর কোন আয়াতকে অবিশ্বাস-অস্বীকার করা মূলত আল্লাহকেই অবিশ্বাস-অস্বীকার করা। আল্লাহ বলেছেন :

‘এটি (নামাজ) খুব কঠিন কাজ, কিন্তু যারা বিনয়ী তাদের পক্ষে খুবই সহজ। যারা মনে করে তাদেরকে প্রতিপালকের মুখোমুখি হতে হবে এবং তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।’-[বাকারা : ৪৫-৪৬]

‘যারা পরকালকে বিশ্বাস করে তারাই কুরআনের প্রতি বিশ্বাসী এবং তারা নামাজকে সংরক্ষণ করে।’-[আনআ’ম : ৯২]

‘যারা আমার আয়াত ও আখেরাতের সাক্ষাতকে মিথ্যা মনে করে তাদের সব আমলই ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা যেমন আমল করেছে তেমন ফলাফলই পাবে।’-[আল আ’রাফ : ১৪৭]

এমনিভাবে আখেরাত সম্পর্কে ভূল ধারনাও মানুষকে গোমরাহীর দিকে ধাবিত করে। জাহেলিয়াতের যুগে লোকেরা পীর, দরবেশ, আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তিদেরকে উসিলা করে পরকালে পার পাওয়ার স্বপ্ন দেখত এবং তাদেরকে নাযাতের কান্ডারী ও যিম্মাদার মনে করত। ইহুদিরা মনে করতো তারা ঈশ্বরের বংশধর। বংশ, গোত্র ও সাম্প্রদায়িক কারণে তারা শাস্তির উর্ধে। বেহেশত তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এমনিভাবে কিছু লোক পীর, দরবেশ, আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের সাথে নিজেদের আত্মীয়তা-ঘনিষ্ঠতা আবিষ্কার করতো আর মনে করত ঐসব ব্যক্তিরাই তাদেরকে নাযাতের ব্যবস্থা করে দিবে। এসব কারণে দুনিয়ার জীবনে আখেরাতের জবাবদিহিতার অনুভূতি তাদের ছিল না। যার কারণে তাদের জীবনধারা পরিচালিত হতো বিভ্রান্তির পথে, ইসলামের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। এসব লোকের বিভ্রান্তি দূর করাও ছিল মহানবীর জীবনের অন্যতম মিশন। তিনি পবিত্র কালামের বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে তাদেরকে হুশিয়ারী করে গেছেন :

‘ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানরা বলে : আমরা আল্লাহর সন্তান ও তাঁর প্রিয়জন। বল, তবে তিনি তোমাদেরকে পাপের বিনিময়ে শাস্তি দেবেন কেন? বরং তোমরাও অন্যদের মতই সাধারণ মানুষ মাত্র। তিনি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন এবং যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেবেন। আকাশ, পৃথিবী ও এর মধ্যকার সব কিছুর উপর আল্লাহর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর দিকেই সবাইকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’-[আল মায়েদা : ১৮]

‘তারা বলে, ইহুদী অথবা খ্রিস্টান ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। এটি তাদের বাসনা। বলে দাও, তোমরা সত্যবাদী হলে প্রমাণ উপস্থিত কর। হ্যা, যে নিজেকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দিয়েছে এবং সৎকর্মশীল হয়েছে, তার জন্য তার পালনকর্তার নিকট পুরষ্কার রয়েছে। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’-[বাকারা : ১১১-১১২]

‘তারা বলে, জাহান্নামের আগুন আমাদেরকে স্পর্শ করবে না। যদিও বা করে তবে তা নির্দিষ্ট কয়েকদিনের জন্য মাত্র। জিজ্ঞেস কর, তোমরা কি এ ব্যাপারে আল্লাহর কাছ থেকে কোন প্রতিশ্রুতি পেয়েছো যে, তিনি কখনও তা ভঙ্গ করবেন না? নাকি তোমরা যা জানো না তা আল্লাহর সাথে জুড়ে দিচ্ছো? হ্যা, যে ব্যক্তি গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হয়েছে এবং পাপাচারের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে তারা জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে। আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারা জান্নাতের অধিবাসী হবে, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।’-[বাকারা : ৮০-৮২]

‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ পেয়েছে। আল্লাহর কিতাবের দিকে তাদেরকে আহবান জানানো হয়েছিল, যেন তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে একদল অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ, তারা বলে : জাহান্নামের আগুন আমাদের স্পর্শ করবে না, যদিও করে, তা হাতে গোণা কয়েক দিনের জন্য। নিজেদের উদ্ভাবিত ভিত্তিহীন কথায় তারা ধোঁকা খেয়েছে। তখন তাদের অবস্থা কী হবে, যেদিন আমি তাদেরকে সমবেত করব এবং যেদিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই? সেদিন প্রত্যেকেই তাদের কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে, কারো উপরই সামান্যতম অন্যায়ও করা হবে না।’-[আলে ইমরান : ২৩-২৫]

‘তারা বলে - এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। বলে দাও, তোমরা কি আল্লাহকে আসমান ও জমিনের এমন সব বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছ, যে সম্পর্কে তিনি জানেন না?’-[ইউনুস : ১৮]

‘তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছো, আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম তা পেছনে রেখে এসেছো। আমি তো তোমাদের সাথে সেই সুপারিশকারীদের দেখছি না, যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল, তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। বাস্তবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবীও উধাও হয়ে গেছে।’-[আল আন‘আম ৯৪]


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন