বুধবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২১

ইসলাম শিক্ষাকে উৎসাহিত করে যা বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করে

ইসলাম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে কোন মতবিরোধ বা দ্বন্দ্ব  নেই।  ইসলাম তার সমস্ত ইতিহাসে কখনো বিজ্ঞানকে নিষিদ্ধ করেনি; বিপরীতে, এটি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জ্ঞান অর্জনকে উত্সাহিত করেছে এবং নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করাকে বাধ্যতামূলক করেছে। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সমূহ কখনও  ইসলামের সত্যতাকে নাকচ করেনি,বরং বিজ্ঞান ক্রমাগতভাবে ইসলামের শিক্ষাকে নিশ্চিত করেছে। বিজ্ঞান কেন ও কীভাবে ইসলামের সত্যতাকে অস্বীকার করবে? বিজ্ঞান তো সৃষ্টি জগতের মধ্যে বিদ্যমান আল্লাহ প্রদত্ত  নিয়মগুলোই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। ইসলাম একটি ঐশ্বরিক ধর্ম যা আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ এবং তিনিই এর মূল রূপ সংরক্ষণ করেছেন। তাই ইসলাম ও বিজ্ঞানের উৎস একই। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে স্রষ্টার মহিমা, শক্তি এবং তাঁর জ্ঞানের অসীমতা আরও ভালভাবে জানা যায়, এবং তাঁর প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরও গভীর হয়। এই কারণে, বিজ্ঞান ইসলামের একটি অন্তর্নিহিত অংশ।

আল্লাহর সুন্দর ঐতিহ্যবাহী নামগুলির মধ্যে অনেকগলো রয়েছে যা প্রকাশ করে যে আল্লাহ গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু জানেন এবং তিনি কীভাবে সবকিছু জানেন তাও প্রকাশ করা হয়েছে।

কুরআন ও হাদীসে মানুষকে জ্ঞান অন্বেষণে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে। মহান আল্লাহ বলেনঃ
"বল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে জ্ঞানের দিকে অগ্রসর করুন।" (তা-হা,  ২০:১১৪)

"তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উন্নীত করবেন।" (আল-মুজাদিলা,৫৮:১১)

আমাদের হুজুর, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

“যদি কেউ জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা নিয়ে কোনো পথে প্রবেশ করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথের একটিতে স্থাপন করেন। যেহেতু ফেরেশতারা সে যা করে তাতে সন্তুষ্ট হয় তারা তার উপর তাদের ডানা প্রসারিত করে। আসমান-জমিনের সবকিছু, এমনকি পানির নিচের মাছও আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। উপাসকদের উপর জ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠত্ব তেমন, যেমনটা আমরা পূর্ণিমার রাতে তারাদের উপর চাঁদের ঔজ্বল্য উদ্ভাসিত হতে দেখি।। আলেমরা নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীরা স্বর্ণ ও রৌপ্য অসিয়ত করেন না; তারা জ্ঞান দান করে। যে কেউ এই উত্তরাধিকার গ্রহণ করে সে অনেক বড় অনুগ্রহ গ্রহণ করে।" (আবু দাউদ, জ্ঞান, ১/৩৬৪১; তিরমিজি, জ্ঞান, 19/2682। দেখুন, বুখারি, জ্ঞান, ১০; ইবন-ই মাজা, মুকাদ্দিমা, ১৭)

"জ্ঞান হল মুমিনের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ: সে যেখানেই এটি পায় সেখান থেকেই তা ফিরে পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।" (তির-মিজি, জ্ঞান,১৯/২৬৮৭; ইবনু মাজাহ, তাকওয়া, ১৫) 

"একজন বিশ্বাসীর জ্ঞানের তৃষ্ণা কখনই মেটানো যায় না যতক্ষণ না সে তার চূড়ান্ত মঞ্জিল  - জান্নাত লাভ করে।" (তির-মিযী, জ্ঞান, ১৯/২৬৮৬)

এ কারণে মুসলমানরা বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দিতে আহমদ এন-নাহাওয়ান্দি জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। পরবর্তীকালে, তারা দুর্দান্ত মানমন্দির তৈরি করেছিলেন। এছাড়া জ্যোতির্বিদ্যার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র অ্যাস্ট্রোল্যাব তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে তারা সূর্য, নক্ষত্র এবং অন্যান্য গ্রহের জ্যোতির্বিদ্যাগত উচ্চতা, মহাজাগতিক সময়, পাহাড়ের উচ্চতা এবং কূপের গভীরতা পরিমাপ করেতেন। এই কাজের ফলস্বরূপ, পুরানো ধ্রুবকগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয়েছিল এবং নতুন তারকা সমূহের ক্যাটালগ বা শ্রেণিবিন্যাসকৃত তালিকা  প্রস্তুত করা হয়েছিল। মুসলমানদের অবদানের কারণেই অনেক নতুন নক্ষত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, গ্রহের প্রবণতার মাত্রা আবার পরিমাপ করা হয়েছে, সূর্যের চূড়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং স্থিতিশীল নক্ষত্রের সাথে সম্পর্কিত এবং গ্রহের গতিবিধির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোও তখন হয়েছিল ছিল।

মুসলমানরা জ্যোতির্বিদ্যায় গণিতের প্রয়োগে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। "অবিচ্ছিন্ন রশ্মি" (continuous beams) এর পরিবর্তে তারা ত্রিকোণমিতি এবং সাইনাস গণনা ব্যবহার করেছিল এবং অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট পরিমাপ পেতে সক্ষম হয়েছিল। তারা গ্রহের গতিবিধি পরিমাপের সাথে সম্পর্কিত কৌশল উদ্ভাবন ও ব্যবহারে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছিল।

একইভাবে, মুসলমানরা ভূতত্ত্ব, খনিজবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, গণিত-বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা এবং ফার্মেসি বিজ্ঞানে অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার করে এবং বিজ্ঞানের এই শাখা গুলোর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) একাই ২৯টি বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্কলার ছিলেন। তার একক গবেষণা ও আবিষ্কার সমূহ জ্ঞান বিজ্ঞানে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের পথ প্রশস্ত করেছিল। তাঁর ‌'আল-কানুন ফিত-তিব'-কে ইউরোপে বলা হতো 'দ্য ক্যানন ইন মেডিসিন', যা ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ৬০০ বছর ধরে পড়ানো হয়েছিল। চোখের রেটিনা লেয়ারের কার্যকারিতার বিষয়ে যিনি প্রথম অবহিত করেন তিনি ছিলেন ইবনে-ই রুশদ (১১২৬-১১৯৮)। চক্ষু বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ গবেষক ছিলেন আলী বিন ঈসা (একাদশ শতাব্দী), তাঁর রচিত তাজকিরাতুল কাহ-হালিন (Tazkiratu’l Kah-halin) বহু শতাব্দী ধরে দৃষ্টিবিজ্ঞানের একমাত্র পাঠ্যপুস্তক হিসাবে রয়ে গেছে এবং ল্যাটিন, জার্মান এবং ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। আম্মার বিন আলী (দ্বাদশ শতাব্দী) নয় শতাব্দী আগে চোখের অস্ত্রোপচার করেছিলেন এবং তিনি তার বই আল মুনতাখাব ফি 'ইলাজিল আইন'-এ ছানি অপসারণ কীভাবে করেছিলেন তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই বইটিও তৎকালীন প্রধান ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। ইবনে হাইথাম (আলহাজেন) (৯৬৫-১০৫১) চশমা আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিদ এবং চক্ষুবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা।  আলী বিন আব্বাস (৯৬৪) ক্যান্সারের অস্ত্রোপচার করেছিলেন যা আজকের আধুনিক অস্ত্রোপচারের কৌশলগুলিকে পূর্বনির্ধারিত করেছিল। তাঁর অমর গ্রন্থ কিতাবুল-মালিকি একটি ওষুধের বিশ্বকোষ, যা আজও প্রশংসার সাথে মূল্যায়ন করা হয়।আবুল কাশেম আজ জাহরাভি (৯৬৩-১০১৩) সার্জারিকে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক শাখায় পরিণত করেছেন। তিনি অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত প্রায় ২০০টি টুলের ছবি আঁকেন এবং তাঁর তাসরিফ নামক বইতে সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন। হৃদযন্ত্রের মাইক্রোসার্কুলেশন সিস্টেম আবিষ্কার করেছিলেন ইবনে আল-নাফিস, যিনি ১২১০ থেকে ১২৮৮ সালের মধ্যে বিদ্যমান ছিলেন এবং তিনি ইবনে-ই সিনার কানুন-এর একটি ভাষ্যতে এটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। মধ্যযুগের মুসলিম বিজ্ঞানী আকশেমসেদ্দিন (১৩৮৯-১৪৫৯)তার মাদ্দেত আল-হায়াত নামক বইতে জীবাণু সম্পর্কে নিম্নলিখিত বলেছিলেন: “এটা ভাবা ভুল যে অসুস্থতাগুলি স্বাধীনভাবে মানুষের মধ্যে ঘটে। অসুস্থতা ছোঁয়াচে। এর বিস্তার ঘটে জীবিত বীজের কারণে যা এত ছোট যে সেগুলি মানুষের চোখে দেখা যায় না।" গণিত শাস্ত্রের ইতিহাসে যিনি শূন্য সংখ্যা ব্যবহার চালু করেছিলেন তিনি মুসলিম গণিতজ্ঞ হারিজমি (৭৮০-৮৫০)। তিনি বীজগণিতের (আল জাবরা) ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর বই আল-জাবর ওয়া-ল-মুকাবালা’র  সাথে মিলিয়ে এটির নামকরণ করেছিলেন। নবম শতাব্দীর বনু মুসা বা মুসার পুত্ররা নামে খ্যাতি পাওয়া ভ্রাতৃত্রয় খুব ছোটখাটো ত্রুটি থাকলেও গোটা পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন। বেরুনি-Beyrûnî (৯৭৩-১০৫১), যিনি বিভিন্ন বিষয়ে আবিষ্কার করেগেছেন; প্রমাণ করেছেন যে পৃথিবী নিজের এবং সূর্য উভয়েরই চারপাশে ঘুরছে, এবং তিনি ভারতের নেন্দেন নামক শহরের চারপাশে পরিচালিত গবেষণার মাধ্যমে সফলভাবে পৃথিবীর ব্যাস পরিমাপ করেছেন। এই বিষয়ে তার সূত্র ইউরোপে "বেইরুনি সূত্র" নামে পরিচিত। বাত্তানি (আলবাতেগনি)- Battani (Albategni) মাত্র ২৪ সেকেন্ডের একটি ত্রুটি সহ সৌর বছর গণনা করেছিলেন। ইসমাইল জাওহারী (৯৫০-১০১০) প্রথমবারের মতো উড়তে চেষ্টা করেছিলেন। ইবনে-ই ফিরনাস ৮৮০ সালে বিমানের আবিষ্কারের পথপ্রদর্শক। তিনি পাখির পালক এবং কাপড় দিয়ে বিমান তৈরি করেছিলেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে বাতাসে ভেসে ছিলেন এবং  খুব সহজভাবে অবতরণ করেছিলেন। রাজী-Razi (৮৬৪-৯২৫) সর্ব প্রথম অভিকর্ষের কথা উল্লেখ করেন। ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৪৬-১৫০৬) বলেছিলেন যে তিনি আমেরিকার অস্তিত্বের কথা মুসলমানদের কাছ থেকে শিখেছিলেন, বিশেষ করে ইবনে-ই রুশদের (১১২৬-১১৯৮) বই থেকে। ইদ্রিসি-Idrisi (১১০০-১১৬৬) আট শতাব্দী আগে বিশ্বের মানচিত্র আঁকেন যা আজকের বিশ্বের মানচিত্রের মতো।

ইতিহাস জুড়ে অনেক জায়গায় বিভিন্ন সভ্যতার আবির্ভাব ঘটেছে এবং তারা সকলেই পারস্পরিক প্রভাব ও অবদানের মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিকাশে সাহায্য করেছে। মুসলমানরাও পূর্ববর্তী সভ্যতার জ্ঞান থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। তারা কৃতজ্ঞতার সাথে এটি প্রকাশ করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ, নিজেদের অগ্রগতির মাধ্যমে বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। পূর্ববর্তী সভ্যতার দ্বারা রচিত বইগুলি ইসলামী পণ্ডিতদের দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছিল তবে বিষয়বস্তুগুলি নির্বিচারে নেওয়া হয়নি। সেগুলি প্রথমে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং ভুল অংশগুলি সরানোর পরে উন্নত করা হয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন