শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪

আল কোরআন : পরিবর্তনের চালিকা শক্তি

 


ডঃ মাগদি আল হিলালি
অনুবাদ : মুহাম্মদ আবুল হুসাইন

'রমাযান মাস- যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে; লোকেদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।' -[আল বাকারা : ১৮৫]
পবিত্র কোরআনকে যারা বাস্তবিকই হেদায়াতগ্রন্থ এবং আত্মশুদ্ধির উপায় হিসেবে গ্রহণ করে তাদের জীবনে আল কোরআন বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধন করে থাকে। এ পরিবর্তন হয় বিরাট এবং মৌলিক। কোরআন তাদের চরিত্রের পুনর্গঠন করে এবং তাদেরকে নতুন ছাঁচে, নতুন রূপে গড়ে তোলে, যে রূপকে আল্লাহ খুবই পছন্দ করে থাকেন। কোরআনের এই প্রভাব সম্পর্কে কারো মনে যদি কোন সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে তিনি মহানবীর সাহাবীদের জীবনের দিকেই তাকিয়ে দেখতে পারেন যে তাদের জীবনে কী বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের জীবন ছিল দারুন দুর্বিষহ এবং ঘোর অন্ধকার ও অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত। কিন্তু কোরআনের স্পর্শ তাদের চরিত্রে কী পরিবর্তনটাই না ঘটিয়ে দিল! মূলত এর মাধ্যমে কোরআনের পরিবর্তন ও পুনর্গঠন ক্ষমতারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কোরআনের কারণেই আরবের গরীব, গুরুত্বহীন, নগ্নপদের মরুচারী লোকগুলো নতুন এক আত্মিক-শক্তিতে জেগে উঠল, নতুন ছাঁচে ও নতুন রূপে গড়ে উঠল। তাদের জীবনের দৃষ্টি ও কামনা-বাসনাই বদলে গেল এবং তাদের জীবনবোধ এক উন্নত ও মহান লক্ষপাণে পৌঁছুতে সক্ষম হল। তাদের মন-মানসিকতা ও তাদের হৃদয়গুলো এত উন্নত হল যে, তা যেন আল্লাহর আরশকে স্পর্শ করল। মোটকথা কোরআনের স্পর্শে আরবের বর্বর ও ইতর লোকগুলো সোনার মানুষে পরিণত হল এবং এর ফলে আল্লাহর অঙ্গীকারও সত্যে পরিণত হওয়া সম্ভব হল। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।’-[আর রা’দ : ১১] এই বিরাট নৈতিক বিপ্লবের কারণেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আরবের ঐ মুরুভূমি থেকে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটল, যারা ঐ সময়ের শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিতে সক্ষম হল এবং তাদের কাছ থেকে পৃথিবীর নেতৃত্ব নিয়ে নিল।
এই নাটকীয় পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? সম্ভব হল এ কারণেই যে আল কোরআন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হতে পেরেছিল এবং এবং নবীর নেতৃত্বে তার সাথীরা কোরআনের আহবানে যথাযথভাবে সাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এত বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল, কারণ আরবের লোকেরা কোরআনকে জানতে পেরেছিলেন, উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ কারণে তারা কোরআনকে যথার্থভাবে মর্যাদা দিতে পেরেছিলেন, সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। আর রাসূলকে তারা পেয়েছিলেন কোরআনেরই বাস্তব মডেল বা নমুনা হিসেবে।
আল্লাহর রাসূল তাঁর জীবনে কোরআনকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, কোরআনের চেতনাতেই তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি তাই অনুমোদন করেছেন, যার অনুমোদন কোরআন তাঁকে দিয়েছে এবং কোরআন যা নিষেধ করেছে তিনি তাই নিষেধ করতেন। কাজেই মা আয়েশা যখন নবীজির প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি ছিলেন পৃথিবীর বুকে জীবন্ত কোরআন, তখন তাতে অতিশয়োক্তি বা বিস্ময়কর বলে কিছু থাকে না।
আল্লাহর রাসূল কোরআন তেলাওয়াত করতেন ধীর-স্থির ভাবে এবং স্পষ্ট করে। একবার রাতে নামাজ পড়ার সময় তিনি এই আয়াতটি একাধিক বার পড়েন : ‘(হে আল্লাহ) তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দিতে চাও, তাহলে তারা তো তোমারই বান্দা; আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর, তাহলে তুমি তো মহান এবং জ্ঞানী।’-[আল মায়িদা : ১১৮]
পবিত্র কোরআন মহানবীর জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি বলতেন সূরা হুদ এবং এরূপ অন্যান সূরাগুলো তার অন্তরে অত্যন্ত ভয় জাগ্রত করে। কারণ এ সূরা গুলোতে বিচার দিবসের ভয়াবহ দৃশ্য এবং পূর্ববর্তী নাফরমান ও অভিশপ্ত জাতিসমূহের ধ্বংস এবং তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব সূরা তেলাওয়াত করার সময় তিনি এতটা প্রভাবিত হতেন যে, তাঁর চেহারা ও শরীরেও ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠতো।
সাহাবীগণ মহানবীর পদাংক অনুসরণ করে চলতেন। তাঁরাও মহানবীর মত কোরআন মজিদের মাধুর্যের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছিলেন এবং এর সাথে জীবনের গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আববাদ ইবনে বিশর-এর একটি ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। একবার যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সঃ) হযরত আববাদ এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে রাতের বেলা কাফেলা পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োগ করলেন। প্রথম পালায় আববাদ পাহারায় নিযুক্ত হলেন এবং আম্মার ঘুমাতে লাগলেন। এক পর্যায়ে স্থানটিকে আববাদের কাছে নিরাপদ মনে হল এবং সে কারণে তিনি তার সময় কাটানোর জন্য নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। সে সময় একজন মুশরিক কিন্তু কাফেলাটিকে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে সুযোগ পেয়ে নামাজে দাঁড়ানো হযরত আববাদকে লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ করল। কিন্তু হযরত আববাদ তাঁর শরীরের বাইরেই তীরটি ধরে ফেলেন এবং যথারীতি নামাজ পড়তে লাগলেন। মুশরিকটি আরেকটি তীর নিক্ষেপ করল। আববাদ এটিও ধরে ফেলেন এবং নামাজ অব্যাহত রাখলেন। মুশরিকটি যখন তৃতীয় তীরটি নিক্ষেপ করে সে মুহূর্তে আম্মার সজাগ হয়ে তাকে ঘায়েল করেন এবং আববাদ যথারীতি রুকু ও সিজদা শেষ করেন। আম্মার যখন আববাদকে জিজ্ঞেস করলেন যে প্রথম যখন তিনি আক্রান্ত হন তখন তিনি আম্মারকে কেন জাগালেন না, তখন আম্মার বলেন, ‘আমি একটি সূরা তেলাওয়াত করছিলাম এবং সেটির তেলাওয়াত শেষ না করে থামতে চাইছিলাম না। কিন্তু সে (মুশরিকটি) যখন আমাকে তীর নিক্ষেপ করতেই থাকলো, তখন আমি আপনাকে জাগালাম। আল্লাহর কসম, আমার যদি এ ভয় না থাকতো যে, আল্লাহর নবী আমাকে যে দায়িত্বে নিয়োগ করেছেন তা ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তাহলে সূরাটি শেষ না করা পর্যন্ত কিংবা সে আমাকে শেষ না করা পর্যন্ত আমি তেলাওয়াত থামাতাম না।’-[আবু দাউদ শরীফ]
উপরের দৃষ্টান্তটি থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর নবী এবং তাঁর সাহাবীগণ কোরআনকে শুধু না বুঝে তেলাওয়াত (lip service) করেননি। আসলে কোরআনের আসল মূল্য, তাৎপর্য ও গুরুত্ব তো কেবল তখনই উপলব্ধি করা সম্ভব হবে যখন কোরআনের কথাগুলো জানা ও বুঝা সম্ভব হবে এবং তখনই কোরআন দ্বারা পাঠকের চরিত্রে কার্যকর পরিবর্তন সম্ভব হবে। কোরআন তো চায় পাঠকের হৃদয়ে বিরাজ করতে, তার চিন্তার জগতে ঝড় তুলতে এবং তার চেতনার পুনর্গঠন করতে। কোরআন চায় জীবন ও জগৎ সম্পর্কে প্রচলিত বদ্ধমূল ও ভুল ধারণাগুলোর অপনোদন করতে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও আধ্যাত্মিকতার সঠিক পথ বলে দিতে, কিন্তু কোরআনের অর্থহীন তেলাওয়াতের মাধ্যমে এবং কোরআনের কথাগুলো জানার চেষ্টা না করার মাধ্যমে কি তা সম্ভব? লোকেরা যখন কোরআনের বক্তব্য জানতে ও বুঝতে পারবে তখন তারা যথাযথভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভেও সমর্থ হবে। কিন্তু তা না করে চিন্তামুক্ত তেলাওয়াতের মাধ্যমে একই ফল লাভ সম্ভব নয়। এমনকি কেউ যদি কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা না করে পুরো কোরআন হাজার বারও তেলাওয়াত করে তাহলেও তার দ্বারা কোরআনের শিক্ষা হাসিল করা সম্ভব হবে না।
মহানবীর সাহাবীগণ এ বিষয়টি বার বার স্পষ্ট করে বলেছেন। একবার মা আয়েশা কিছু লোকের কথা জানতে পারলেন যারা এক রাতে ২/৩ বার করে কোরআন খতম করত। তিনি তাদের ব্যাপারে হুশিয়ারী করে বলেন, ‘তারা কোরআন পড়ে বলে মনে করে কিন্তু আসলে তাদের কিছুই পড়া হয় না।’ এ প্রসঙ্গে তিনি মহানবীর কোরআন পড়ার পদ্ধতি বর্ণনা করে বলেন, তিনি সারা রাতে নামাজে শুধুমাত্র সূরা আল বাকারা, আল ইমরান এবং আন নিসা পড়তেন। তিনি আরো বলেন, মহানবী (সঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন তখন সুসংবাদের আয়াত পড়ার সাথে সাথে আল্লাহর দয়া ও রহমত কামনা করতেন এবং ভয়সূচক আয়াত তেলাওয়াত করলে সাথে সাথে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে মুনাজাত করতেন।
একবার আবু জামরা ইবনে আববাসকে বলেন, ‘আমি খুব দ্রুত কোরআন পড়ি এবং তিন দিনে এক খতম দেই। জবাবে ইবনে আববাস বলেন, আমি এ রকম করি না। আমি বুঝে-শুনে এবং সতর্কতার সাথে তেলাওয়াত করে সারা রাতে শুধু মাত্র সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা পছন্দ করি।’
আল আগরি• তার কোরআনের বাহকদের নৈতিকতা বিষয়ক গ্রন্থ বলেছেন, বুঝে-শুনে এবং যথার্থ চিন্তা-ভাবনা করে কোরআনের কিছু অংশ পড়া না বুঝে এবং চিন্তা-ভাবনা না করে অনেকখানি তেলাওয়াত করার চেয়ে উত্তম। আল কোরআনের বহু জায়গায়, মহানবীর সুন্নায় এবং বিখ্যাত মুসলিম মনীষীদের বহু উক্তিতে এ বিষয়টির উপর জোর দেয়া হয়েছে। একবার মুজাহিদকে জিজ্ঞেস করা হল ঐ দু ব্যক্তির মধ্যে কার নামাজ উত্তম যাদের দুজনই একই ভাবে রুকু-সিজদা করে, কিন্তু প্রথম জন তার নামাজে শুধু সূরা বাকারা তেলাওয়াত করে অথচ ঐ একই সময়ে অন্যজন সূরা বাকারা এবং আল ইমরান তেলাওয়াত করে? জবাবে তিনি বললেন, যে জন শুধু সূরা বাকারা তেলাওয়াত করে সেই উত্তম। তিনি তার রায়ের পক্ষে নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাতে বলা হয়েছে : ‘‘এটি সেই কোরআন, যা আমি তোমার প্রতি অল্প অল্প করে নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের কাছে এটি ধীর-স্থির ভাবে তেলাওয়াত করে শোনাতে পার।’-[আল ইসরা : ১০৬]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন