কবিতা সময়কে ধারণ করে। কেননা কালের বিরূপতা কবিমনকেও ব্যথিত করে। কবিরাও মানুষ। তাদেরও মন আছে, ভালোবাসা-ঘৃণা, ব্যাথা-বেদনার অনুভূতি আছে। বরং বোধকরি তাদের মন একটু বেশিই সংবেদনশীল। তাই কালের ক্রুরতা, ঢ়ূরতা, নিষ্ঠুতা, ক্রন্দন ও দ্রোহ কবি ও কবিতাকে স্পর্শ করে, নাড়া দেয়। তবে কবি যেহেতু শিল্পী, তার শিল্পকুশলতায় কালের কবিতাও কালোত্তীর্ণ হতে পারে।
মোশাররফ হোসেন খানের ‘দাহন বেলায়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। তার মানে - গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো লেখা হয় আজ থেকে বাইশ বছর আগে। কিন্ত সে সময়ে ‘বারুদের গন্ধে জেগে ওঠা লাশের যৌবন’ পঙক্তিটি আমাকে যেভাবে শিহরিত করেছিল, এখন তো বোধ হয় আরও বেশি শিহরিত ও উদ্দীপ্ত করে। আমার কাছে তো মনে হয়েছে কবিতাগুলো এই চব্বিশের গণ-আন্দোলনের তরুণদের রক্তে বারুদ জ্বালানোর জন্যই লেখা হয়েছে। অবশ্য, মোশাররফ হোসেন খান আশির দশকের তরুণ কবি হলেও তার কবিতা থেকে তারুণ্যের দীপ্তি একটুও কমেনি। চব্বিশের ছাত্র-জনতা গণ আন্দোলনকে গণ- অভ্যুত্থানে রূপ দিতে তিনি অত্যন্ত সাহসের সাথে রণবাদ্য বাজিয়ে কবিতা লিখেছেন।
দাহন বেলায় কাব্যগ্রন্থে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, অবরুদ্ধ প্রাণচাঞ্চল্য ও কালের বিরূপতা হাহাকার করে ওঠে, যখন কবি বলেন-
'প্রতিদিনের বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলিও এখন বিপরীতার্থক।
দেশকে এখন মনে হচ্ছে মৃত্যু-গহবর
আর মানুষগুলিকে বিষধর অজগর।'
(নখের বিস্তার)
কিংবা-
‘বুনো বাতাসের চোখে ভয়াবহ ক্রোধ:
সমুদ্র প্রহরগুলো বেয়াড়া তার্কিক
কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বুকে অসুখী ময়ুর’
(দাহন বেলায়)
তখন মনে হয়, এই কবিতা তো সদ্য লেখা হয়েছে।
চব্বিশের গণ-আন্দোলন যে প্রেক্ষাপটে দানা বাঁধে, দাহনবেলায়'র কিছু কবিতা প্রায় একই প্রেক্ষাপটে লেখা হয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের পর মানুষ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু হলেও স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশি দেরি লাগেনি। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন ছিল সেটি। যদিও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সংবিধানের অংশ ছিল না, কিন্তু সবগুলো রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে সেটি করা হয়েছিল।... ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। সে সময় নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে শেখ হাসিনা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে তার সেই আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে।' '১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোট দেবার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়। সাড়ে ছয় কোটি ভোটারের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়ে। নির্বাচনে কোথাও কোন ধরণের সহিংসতা দেখা যায়নি।’
এই নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। তবে নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় কোন দল সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।'
এই নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৮৪টি আসনে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে।'
কিন্তু এই নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী শক্তির বিজয় আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তাদের দোসর ফ্যাসিবাদী শক্তি মেনে নিতে পারেনি। তাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহজ পথ ত্যাগ করে তারা দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবেলায় দেশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেখানে বাকশালের একদলীয় দুঃশাসন থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, সেই অবস্থান থেকে জাতিকে বিচ্যূত করতে ফ্যাসিবাদী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের ধুম্রজাল তৈরি করে নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার কুটকৌশল শুরু করে। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্ব গঠিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তারা দেশের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে, জনরায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্র ও আদালতের বিপরীতে গণ-আদালতের নামে বুনো আদালত প্রতিষ্ঠিত করে দেশের মধ্যে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদৌলতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে সেই ব্যবস্থাটিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে গড়িমসি শুরু করে বিএনপি সরকার। যার পরিণতিতে ফ্যাসিবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী জনমতের বিভক্তির সুযোগ নিয়ে ২১ বছর পর আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায় আধিপত্যবাদী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট ফ্যাসিবাদ। ক্ষমতায় আসার পর তাদের এই প্রতিহিংসা আরও বেশি দানা বেঁধে ওঠে। সেই সময়ের ক্ষুধা, দারিদ্র, বিভেদ-বৈষম্য, স্বপ্নহীন হতাশা, পশ্চাৎপদ ও বোধহীন চৈতন্যের দাহন চিত্র দাহন বেলার কবিতাগুলোতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন কবি তার প্রিয়তমাকে বলেন-
“তাকে বলি: একুশ বছর পর হাঙ্গরের দল
আবার উঠেছে জেগে। খরা-বানে ভেঙেছে কপাল।
নদীর উৎসমুখ যতই করুক তোলপাড় -
নাভীর ওপরে এখনতো কেবল পেটের ক্ষুধা।
নাভীর ওপরে কামহীন ক্ষুধা বিশুদ্ধ আগুন।
যে আগুনে ভস্ম হয় শতশত দেশ-মহাদেশ!
তোমার দাবির চেয়ে বেশি দাবি সুষম খাবার,
ভাতের গন্ধের চেয়ে দামী নয় দেহের সাঁতার।
হাঙ্গরের মুখে রেখে বারকোটি ক্ষুধার্ত মানব
স্নানে যাবো না, কসম! ছোঁবনাকো তোমার পশম ॥’
(হাঙ্গর, ২৩.৬.১৯৯৬)
“চারদিকে ধ্বংস ক্ষয় মৃত্যুর কোরাস।
শূন্য ভাতের পাতিল, ধূসর কলস-
নাগিনী নি:শ্বাসে গেয়ে যায় অবিরাম।
এই যাতনার গান, বিষাক্ত অনল
দিনান্তের দীর্ঘশ্বাস, অমল-ধবল-
কেবল কবির জন্য এ ব্যথার ভার।”
(দিনান্তের দীর্ঘশ্বাস)
এখানে দুঃখ-বেদনার পাশাপাশি দ্রোহের আগুনের উত্তাপও অনুভব করা যায়।
এ সময় একটি তোষামোদি শ্রেণি গড়ে ওঠে, যারা তোষামোদি ব্যবসায় রাতারাতি আকাশ ছুঁয়েছে; যার একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় ‘গন্তব্যের দিকে’ কবিতায়-
“সবাই যখন তোষামোদী ব্যবসায় রাতারাতি আকাশ ছুঁয়েছে
পকেটে ভরেছে সুবিধার মুদ্রা
কিংবা পেয়ে গেছে ঝলমলে তপ্ত আসন,
ঠিক তখনও কতটা অবৈষয়িক আমি
দিব্যি মালকোশ বাজিয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছি
শব্দের মতো এক অদরকারি তৈজস!”
এখানে চাটুকারদের বিপরীত অবস্থানে থাকা মানুষের দুঃখ বেদনা ও হতাশার সুরও উঠে এসেছে। এই কবিতাশ হতাশার সুর আরও স্পষ্ট হয় যখন কবি বলে ওঠেন-
“কেন যে এমনি একটি সুবিধাবাদী মূর্খদের
সঙ্গীত শুনিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবার দায়ভার সেধে কাঁধে তুলে নিলাম!
যাদের হৃদয় বলতে কিছু নেই, যাদের বসবাস মানবতার
ঠিক উল্টো পিঠে!
এ সময় বিভাজনের রাজনীতির খপ্পরে পড়ে সমাজ মানস দুষিত হয়, বাড়তে থাকে হিংসা বিদ্বেষ-
“সবাই জানে-এক ফুলকি দ্রোহ, এক ফালি দুর্বিনীত
সাহসের ঢেউ এবং একগুচ্ছ অমেয় প্রত্যয় ছাড়া
পার্থিব সম্পদ বলতে আমার আর কিছুই নেই।
তবু কেন চারপাশে জ্বলে ওঠে দাউ দাউ ঈর্ষার আগুন?”০
(বনমানুষের ডেরায়)
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দাহন বেলায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ, ধ্বংস, নিষ্ঠুরতার ফলে নিপীড়িত মানুষের হাহাকারের শোক ও বিষাদ সঙ্গীতও শুনতে পাই যা কালের ক্রন্দন হয়ে এখনও সমানভাবে আমাদের হৃদয়কে ব্যথীত করে-
‘পৃথিবী উপচে পড়ে বিষণ্ণতা, শকুনের ডাক
চোখের ওপরে মেঘ, মাথার উপর কালো কাক
দূর থেকে ভেসে আসে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর সঙ্গীত
জনপদ লোকালয়ে ছেয়ে যায় শোকের ইঙ্গিত।’
(পাতালের গুহা থেকে)
“ঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছো বারবার তবুও দাঁড়িয়ে আছো। সম্মুখে চলেছো দুর্নিবার!
বিষাক্ত ছোবলে কতবার আক্রান্ত হয়েছো তুমি,
তবুও ছাড়নি এতটুকু তোমার নিজস্ব ভূমি!
কত না হয়েছে পাশাখেলা, কত না ফানুস ছল,
কত যে উঠেছে ফুসে নরপশু, হায়েনার দল। কতভাবে হয়েছো ঝাঁঝরা, তবু স্থির আছো তুমি,
তবুও ছাড়নি এতটুকু তোমার প্রাণের ভূমি।
এখানে ঝরেছে কত প্রাণ- হিসাব রাখেনি কেউ, আছড়ে পড়েছে রক্ত বন্যা- ঝিলাম নদীর ঢেউ! শহীদের খুন মেখে সবুজ হয়েছে গাঢ় লাল, কাফনের পতাকায় লিখে গেছো নাম- চিরকাল।
(অবাক কাশ্মীর)
“পৃথিবী চলেছে মৌসুমী বায়ুর পিঠে।
এখন শ্রাবণ।
মেঘগুলো যাযাবর বেদের বহর।
গুণটানা মাঝির মতো আমরা ক্লান্ত যখন, যখন ঘরে ফিরছি প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে, গুজরাট তখন ফুঁপিয়ে উঠছে প্রচণ্ড পিপাসায়।
রক্তবৃষ্টি ছাড়া সেখানে আসে না শ্রাবণ!
(গুজরাট এবং রক্তাক্ত শ্রাবণ)
“উপমাহীন এক বিধ্বস্ত ভূখণ্ডের নাম- কসোেভা!
বলকানের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে লুহাওয়া প্রিস্টিনা এখন লাশের নগরী পাহাড়ী ঝরনার মত গড়িয়ে পড়ছে কেবল রক্তবৃষ্টি।
কসোভার জীবন এখন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর!
কসোভা মানেই যেন সার্বিয় হায়েনার হিংসার দাবানল!
কসোভা মানেই আমার সূর্যের সমান দীর্ঘশ্বাস!”
(কসোভা ‘৯১)
এই শোক, এই মৃত্যুর সঙ্গীত এই ধ্বংস যেন আজ আমাদের নিত্য নিয়তি হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষের উপর চালানো হচ্চে পৈশাচিক গণহত্যা। আমরা যেন এতে অনেকটা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি। কিন্তু কবির মন তা কখনো মানতে পারে না। তিনি বলে ওঠেন-
'আমার এ চোখ দেখতে অপারগ মানুষের ধ্বংসাবশেষ
অথচ প্রতিদিনই দেখতে হচ্ছে বিভৎস কংকাল'
ঘুমুতে যাবার আগে প্রার্থনায় নত হই:
প্রভু, তোমার অলৌকিক ফুৎকারে
এই পৃথিবী বাসযোগ্য করে দাও।
কাল প্রভাতেই যেন দেখতে পাই মানুষের উত্থান
(সবুজ উত্থান)
দাহন বেলায় হতাশা, হাহাকার, স্বপ্নভঙ্গের বেদনার পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়াবার আহবান, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, দ্রোহ অনিবার্য শব্দ ও পঙ্ক্তির দ্যোতনায় এমনভাবে উঠে এসেছে যা যুগ-যুগান্তর ও লোক লোকান্তরে হৃদয়-মনকে দোলা দিয়ে যায়।
যেমন, 'পাতালের গুহা থেকে' যখন কবি বলেন-
‘মানুষ তরঙ্গ হও, মুছে ফেলো শোকের ললাট
মানুষ সমুদ্র হও, ভেঙ্গে চলো কালের কপাটl’
তখন দুর্বিনীত সাহসে জেগে ওঠে তারুণ্য। এ কবিতার প্রতিটি পংক্তি অনবদ্ধ শব্দ ও ছন্দের গাঁথুনিতে দ্যোতনা ছড়ায়। যেমন:
‘শাণিত প্রহর ভেঙ্গে তবু এসো দীপ্রমহাকাল
রক্তের তরঙ্গ ফুঁড়ে জেগে ওঠো সমুদ্র উত্তাল।
পাহাড় টপকে এসো দুর্বিনীত সাহসের ঘোড়া
জেগে ওঠো জনপদ-লোকালয়, পর্বতের চূড়া।’
থাকনা শোকের নদী, আসমুদ্র হৃদয়ের জ্বালা
তবুও ক্রন্দন নয়। শুরু হোক হিসাবের পালা।
পাতালের গুহা থেকে জেগে ওঠো সাহসের ঘোড়া
জেগে ওঠো জনপদ-হিমালয়, পর্বতের চূড়া।
প্রতিটি কবিতায় হাহাকারের পরই শক্তি সঞ্চয়, স্বপ্নের অঙ্গীকার দেখা যায়। যেমন সবুজ উদ্যান কবিতায় কবি বলেন-
‘মানব জন্মের এই এক করুণ পরিণতি
জানি না, কতোকাল আর দেখে যেতে হবে দুঃসহ রক্তনদী
আমার এ চোখ দেখতে অপরাগ মানুষের ধ্বংসাবশেষ
অথচ প্রতিদিনই দেখতে হচ্ছে বীভৎস কংকাল
তবুও আমি অপেক্ষায় আছি
আমিতো দেখে যেতে চাই-
উৎসবমুখর পৃথিবী
আর মানুষের সবুজ উত্থান।
দাহন বেলায় কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যে একটি সময়ের অবয়ব ও তার দাহন যন্ত্রণার চিত্রকল্প উঠে আসে। তবে মনে হয় সেই সময়টা এবং তার দাহন যন্ত্রণা যেন চলমান। এই দাহন বেলায় তাই অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক টানাপোড়নের ছায়াপাত রয়েছে।
যেমন:
শিয়রে শকুন ওড়ে, ধূসর খামার!
এ ভূমি সেনের নয় - তোমার আমার।
(এ ভূমি সেনের নয়)
রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রভাব একটি জনপদে কী প্রভাব ফেলে তা এ কবিতাটিতে অপূর্ব শিল্প সুষমায় ফুটে উঠেছে-
এ নয় চোখের দেখা- দেখার অধিক।
পাতার মর্মর ধ্বনি, মৃত্যুর নূপুর
ক্ষুধার ক্রন্দন আর দহন-দুপুর-
এ নয় জীবন খেলা- বীজের অলীক।
চোখের ভিতরে বিষ-বিষাদের ছায়া।
কখন যে খসে গেছে তালুকের তাজ,
সবুজ মথিত করে উড়ে গেছে বাজ-
মথিত করেছে আর মাতৃত্বের মায়া।
রক্তে ভেজা মেজরাফ- মূর্ছনায় নীল!
উধাও সঙ্গীত-সুর, বেড়েছে রোদন-
ঘাতক কেড়েছে সুখ-সুখের বোধন,
পৃথিবীর মুখে দেখ কালিমার তিল।
দাহন যন্ত্রণা থাকলেও কবিদের কাজ কিন্তু স্বপ্ন দেখানো। কবি মোশাররফ হোসেন খান তাই শত প্রতিকূলতা ও হতাশার মধ্যেও সাহস ও স্বপ্নের কথা অনিবার্য শব্দের গাঁথুনিতে তুলে ধরেছেন।
শত ঝঞ্ঝা, শত বাধা- পথ চলে যায় বহু দূর-
তবুও আরেক প্রান্তে দেখি মুখরিত পরিবেশ
কান পেতে শুনি- কার যেন বেহালার সুর-
বিপুল বিস্ময়ে বাজে; জেগে ওঠে সবুজ স্বদেশ।
এভাবেই কাটে দিন, অগণন তারাহীন রাত,
অমাবস্যা শেষে হাসে ঝলমলে পূর্ণিমার চাঁদ ॥
‘দাহন বেলায়’ কবিতায় জলহীন দাহন বেলায় বোধহীন তারুণ্য যেন চৈতন্যহীন লাশ। এ অবস্থায় হিরন্ময় ইস্পাতের আকাঙ্ক্ষায় থাকেন কবি। তিনি অপেক্ষায় আছেন কোন এক অবাধ্য বালকের। কেননা তার হাতে আছে বোধের বারুদ।
“কোথায় লুকিয়ে আছে হিরন্ময় ইস্পাত
উপত্যকার শিখর থেকে উড়ে যায় অবাধ্য বালক
বালক ছড়িয়ে যায় দু'হাতে বারুদ
বারুদের গন্ধে জেগে ওঠে লাশের যৌবন
যখন যৌবন জাগে- দাহ্যের পশমে উল্কি আঁকে সুঁচের নখর হ্রদের অতল থেকে উঠে আসে বজ্রের কোরাস থেমে যায় দাবদাহ, দাঁতালো প্রবাহ
যখন যৌবন জাগে-
তখন আশ্চর্য অন্ধকার ফুঁড়ে
পৃথিবীর উঠোন পেরিয়ে
কবরের পর কবর মাড়িয়ে ছুটে চলে নক্ষত্রের ব্যাধ
ছুটে চলে-
বৈশাখী ঘোড়ার পিঠে অবাধ্য বালক জলহীন দাহন বেলায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন