রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

পৃথিবীর বাসযোগ্যতা : আল্লাহর অসীম দয়া

 


মুহাম্মদ আবুল হুসাইন 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধু আমাদের সৃষ্টিকর্তাই নন; তিনি আমাদের প্রতিপালকও। প্রতিমুহূর্তে আমরা আল্লাহর দয়ায় বেঁচে আছি, তাঁর দয়ার মধ্যেই ডুবে আছি। আল্লাহর অসীম দয়ার একটি নিদর্শন হলো পৃথিবীর বাসযোগ্যতা। এই যে আমরা প্রতিমুহূর্তে শ্বাস নেই ও ত্যাগ করি; অক্সিজেন গ্রহণ করি এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি এটা শুধুমাত্র আল্লাহর দয়ার কারণেই সম্ভব হচ্ছে। কারণ এই আলো বাতাস অক্সিজেন উদ্ভিদ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য - এসবই আল্লাহর দয়ার নিদর্শন । তিনি আমাদের জন্য পৃথিবী নামক গ্রহটিকে বাসযোগ্য করে সৃষ্টি করেছেন।

পৃথিবীর বাসযোগ্যতা মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে অনন্য। সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, যেমন - বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুনের তুলনায় পৃথিবীর পরিবেশ মানুষের বসবাসের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল, গঠন, তাপমাত্রা, পরিবেশ, জলবায়ু, সূর্যের আলো, বাতাস, পানি, মাটি, প্রাকৃতিক সম্পদ, খাদ্যশস্য, পশুপাখি, সবকিছুই মানুষের জীবন ধারণের জন্য বিশেষভাবে পরিকল্পিত। মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। এ সেগুলো আমাদের বিবেচনায় থাকা উচিত, স্মরণে থাকা উচিত। তাহলেই আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারব, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারবো এবং তাঁর প্রতি বিনয়ী হতে পারব।

বস্তুত, সৃষ্টিকে জানার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার মহিমা উপলব্ধি করা যায়। কারণ, সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার অসীম দয়া ও কুদরতের নিদর্শন বিদ্যমান। প্রকৃতি, জীবজন্তু, মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুতেই স্রষ্টার অস্তিত্ব ও করুণা প্রকাশিত। আমরা যত বেশি সৃষ্টিকে জানব, প্রকৃতিকে জানবো, তত বেশি আমাদের প্রতি স্রষ্টার অপরিসীম অনুগ্রহকে উপলব্ধি করতে পারব, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারব। আর স্রষ্টার প্রতি এই কৃতজ্ঞ হওয়াটা আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। শুধু অন্তরের প্রশান্তির প্রয়োজনেই নয়; সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সৃষ্টিকে ভালোবাসার জন্যও প্রয়োজন। কারণ, স্রষ্টাকে যে ভালবাসতে পারে না, স্রষ্টার প্রতি যে কৃতজ্ঞ হতে পারেনা সে মানুষকেও ভালোবাসতে পারে না এবং মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞ হতে পারে না। 

আল্লাহ বলেছেন, তিনি আকাশ ও পৃথিবীর কোন কিছুকেই অনর্থক সৃষ্টি করেননি। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি, দিন-রাতের পরিবর্তন, সমুদ্র, পর্বত, বৃক্ষলতা, পশুপাখি - কোন কিছুই তিনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। তিনি আরো বলেছেন, আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। 

তাই আমরা সৃষ্টিজগৎকে জানার চেষ্টা করব যাতে আমরা আমাদের প্রতি আমাদের মহান প্রভুর দয়া ও অনুগ্রহকে উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারি এবং তার সৃষ্টি থেকে যথাযথভাবে উপকৃত হতে পারি।

বাসযোগ্যতার  জন্য পৃথিবী যেসব কারণে অনন্য:

১.উপযুক্ত তাপমাত্রা:

পৃথিবী  তাপমাত্রা এমন একটি পরিসরে থাকে যা জীবন ধারণের জন্য সহায়ক। এটি খুব বেশি গরম বা খুব ঠান্ডা নয়। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যার কারণে এর তাপমাত্রা জীবন ধারনের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক। অথচ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ বিদ্যমান । যেমন: বুধ গ্রহের দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৪২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।  আবার রাতের তাপমাত্রা প্রায় -১৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। আবার শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৪৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।

অন্যদিকে, মঙ্গলের তাপমাত্রা অত্যাধিক শীতল। এর গড় তাপমাত্রা প্রায় -৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন এই গ্রহগুলো বরফের দৈত্য হিসাবে পরিচিত এবং এদের তাপমাত্রা আরও কম, প্রায় -১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে -২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে।

২. সৌরজগতে পৃথিবীর সঠিক অবস্থান ও সঠিক দূরত্ব  দূরত্ব:

পৃথিবী সূর্য থেকে দূরত্বের দিক থেকে তৃতীয় গ্রহ এবং সৌরজগতের আটটি গ্রহের মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম। এটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে এবং সৌরজগতের চারটি কঠিন গ্রহের অন্যতম।

পৃথিবীর তাপমাত্রা বসবাসের উপযোগী হওয়ার একটি প্রধান কারণ হল সূর্য থেকে পৃথিবীর সঠিক অবস্থান ও  দূরত্ব। এই স্থানেই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ বিদ্যমান। পৃথিবী সূর্যের থেকে সঠিক দূরত্বে অবস্থিত হওয়ায় এখানে তরল পানি থাকার উপযোগী তাপমাত্রা বিরাজ করে, যা জীবনের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও, পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি এবং পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে তার অক্ষের আনতি বিভিন্ন ঋতুচক্র তৈরি করে যা জীবজগতের জন্য প্রয়োজনীয়।

এই দূরত্বের কারণে সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং তাপ উৎপন্ন করে, যা দিনের বেলায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং রাতের বেলায় বিকিরণ করে তাপমাত্রা কমিয়ে আনে।

যদি পৃথিবী সৌরজগতের অন্য কোনো স্থানে থাকত, তবে সম্ভবত সেখানে জীবনের অস্তিত্ব থাকত না। কারণ, অন্যান্য গ্রহের পরিবেশ মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নয়।

৩. পানির উপস্থিতি:

পানি শব্দটি উচ্চারণ করলেই আমাদের মনে জল বা তরল পদার্থ ভেসে উঠে যা পৃথিবীর জলমন্ডলের একটি প্রধান উপাদান এবং জীবনের জন্য অপরিহার্য। পৃথিবীর পৃষ্ঠে তরল পানি প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। অন্যান্য গ্রহে পানির উপস্থিতি থাকলেও, পৃথিবীর মতো তরল অবস্থায় সহজে পাওয়া যায় না। অন্যান্য গ্রহে হয়তো পানি আছে, কিন্তু তা কঠিন বা গ্যাসীয় আকারে থাকতে পারে।

৪. বায়ুমণ্ডল:

বায়ুমণ্ডল হলো পৃথিবীর চারপাশে ঘিরে থাকা গ্যাসীয় স্তর, যা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের কারণে আটকে থাকে। এটি সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। 

সহজভাবে বললে, বায়ুমণ্ডল হলো পৃথিবীর চারপাশের বাতাসের স্তর। এই স্তরটি বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত, যেমন - নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি। 

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান সঠিক পরিমাণে ও অনুপাতে বিদ্যমান রয়েছে। প্রধান উপাদানগুলো হলো নাইট্রোজেন (প্রায় ৭৮%), অক্সিজেন (প্রায় ২১%), এবং অল্প পরিমাণে আর্গন, কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য গ্যাস। এই গ্যাসগুলির সঠিক মিশ্রণ পৃথিবীর জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। বায়ুমণ্ডলের এই গ্যাসীয় উপাদানগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সঠিক অনুপাতে বিদ্যমান থাকা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলছে। এই গ্যাসগুলোর যেকোনো একটির পরিমাণ যদি কম বা বেশি হতো তাহলেও পৃথিবীর পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ত এবং পৃথিবী বাসযোগ্যতা  হারাতে।

৫. স্থিতিশীল জলবায়ু:

এছাড়া পৃথিবীর জলবায়ু তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জীবনকে বিকশিত হতে দিয়েছে। অন্যান্য গ্রহের জলবায়ু অনেক বেশি পরিবর্তনশীল।

পৃথিবীর স্থিতিশীল জলবায়ু মানুষের জীবন ও প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য। এর গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি খাদ্য উৎপাদন, পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য, এবং সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। জলবায়ু স্থিতিশীল না থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, যা মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৬. চৌম্বক ক্ষেত্র:

চৌম্বক ক্ষেত্র বা (magnetic field) আমাদের গ্রহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সৌর বায়ু (solar wind) থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে এবং আমাদের বায়ুমণ্ডলকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। এই চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকলে, সৌর বায়ু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিত এবং জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ত। এছাড়াও, এটি নেভিগেশন এবং প্রাণীদের দিক নির্ণয়েও সাহায্য করে।

৭.উপযুক্ত আকার ও ভর:

সঠিক আকার ও ভর (5.972 × 10^24 কেজি) পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ, জলবায়ু, এবং জীবনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক। পৃথিবীর ভর এবং আকার এমন যে এটি মহাকাশে একটি শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র তৈরি করে। এই মাধ্যাকর্ষণ বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখতে এবং গ্রহটিকে সৌরজগতের অন্যান্য বস্তুর সাথে স্থিতিশীল কক্ষপথে রাখতে সাহায্য করে। 

উপযুক্ত মাধ্যাকর্ষণ একটি বায়ুমণ্ডল তৈরি করতে এবং ধরে রাখতে সাহায্য করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করে এবং সৌর বিকিরণ ও গ্রহাণুর আঘাত থেকে রক্ষা করে। 

পৃথিবীর আকার এবং ভর,  ঘূর্ণন এবং কক্ষপথের সাথে মিলিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করে। এটি ঋতু এবং তাপমাত্রা পরিবর্তনের একটি উপযুক্ত পরিসর তৈরি করে, যা জীবনের জন্য অপরিহার্য। 

পৃথিবীর ভর এবং মাধ্যাকর্ষণ পৃষ্ঠে পানির উপস্থিতি নিশ্চিত করে। পানি জীবনের জন্য অপরিহার্য এবং পৃথিবীর জলবায়ু ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

পৃথিবীর আকার, ভর, এবং কক্ষপথ এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে যেখানে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা, পানি, এবং বায়ুমণ্ডল বিদ্যমান। 

যদি পৃথিবীর ভর বা আকার ভিন্ন হতো, তবে এটি গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ, বায়ুমণ্ডল, জলবায়ু এবং জীবনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করত।

সুতরাং, পৃথিবীর এই বাসযোগ্যতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ নেয়ামত, যা আমাদের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। আমাদের উচিত তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং এই নেয়ামতকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা।#


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন