বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৯

পরিবার ও প্যারেন্টিং: জাতিগঠনের মূল সূত্র [দুই]


পরিবার হলো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র। এরপর প্রতিবেশি, স্কুল প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজের বৃহৎ অঙ্গনে সে প্রবেশ করতে থাকে। সেখানে নানাবিধ বিরূপ প্রতিবেশের মাধ্যমে তাকে এগিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়ার শক্তিটা কিন্তু সে পায় বা পাওয়া উচিত পরিবারের কাছ থেকে। যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আমরা আমাদের সন্তানদের পাঠাচ্ছি সেখানকার পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা কতটা মানসম্মত, সন্তানকে মানুষ করার জন্য যে অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের হাতে তুলে দিচ্ছি তারা কতটা সৎ, যোগ্য ও আন্তরিক তা নিয়ে এখন রীতিমত ভাবতে হচ্ছে। কারণ আমাদের দেশে নৈতিক অবক্ষয় এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, মানুষ গড়ার কারীগর শিক্ষকরাও আজ বিতর্কের উর্ধে নয়। তাদের নীতি-নৈতিকতাও আজ প্রশ্ন উঠছে। তাছাড়া এক সময় শিক্ষা বিস্তার ও মানুষ গড়ার মহান প্রত্যয় নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া হলেও বর্তমানে সেই প্রবণতা একেবারেই অনুপস্থিত বলা যায়। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে সেই সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। মুষ্টিমেয় কিছু মাদ্রাসা ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা প্রধান শিক্ষকরা দুর্নীতিতে আক্রান্ত। বিশেষ করে বেসরকারী শিশু শিক্ষালয়, স্কুল ও কলেজের অবস্থা বেশি খারাপ। পাঠ্যপুস্তকে যতই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার কথা লেখা থাক; কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা, পরিচালক বা শিক্ষক-শিক্ষিকারা যখন দুর্নীতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার শক্তিটা পাবে কোথা থেকে?
এর পাশাপাশি এখন আবার হাতে হাতে মোবাইল। মোবাইল এখন আর শুধু মাত্র ল্যান্ড ফোনের বিকল্প বা কথা বলার যন্ত্র নয়। একেকটি মোবাইল এখন একেকটি মিনি কম্পিউটার বা তার চেয়েও বেশি। মোবাইল ফোনের নিশ্চয়ই অনেক ইতিবাচক দিক আছে, কিন্ত ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের চরিত্র হননের বড় হাতিয়ার হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ, পর্ণগ্রাফি এখন এক বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া এবং টেভি চ্যানেলের মাধ্যমে পর্ণ ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ ও যুব সমাজের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। এছাড়া এক শ্রেণির মিডিয়া (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন) বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া বিনোদন, নাটক ও সিনেমার নামে অশ্লীলতার ব্যবসায় করছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, একদিকে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থী তথা তরুণ ও যুব সমাজ কোন নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না; অন্যদিকে ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল ও অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে পর্ণ ও অশ্লীল ভিডিও দেখে এবং সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন ডেটিং সাইটের মাধ্যমে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষের অবাধ যোগাযোগের কারণে নতুন প্রজন্ম নৈতিক ধসের শিকার হচ্ছে এবং এর ফলশ্রুতিতে জেনা-ব্যাভচার, ধর্ষণ, নবজাতক হত্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।এখন যত্রতত্র নবজাতকের লাশ পাওয়া যাচ্ছে, ডাস্টবিন, ড্রেন কিংবা ধানক্ষেত-পাটক্ষেত থেকে সদ্য ভূমিষ্ট নবজাতকদের উদ্ধার করতে হচ্ছে।সব শিশুই নিষ্পাপ; কিন্তু এই শিশুদেরকে যারা অসম্মানজনক পরিচয় প্রদান করছে তাদের বাবা মার অনৈতিক সম্পর্ক।
সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো মাদকাসক্তি। এটা আমাদের জন্য এখন একটি জ¦লন্ত সামাজিক সমস্যা। মাদক আমাদের যুব শক্তিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। দেশজুড়ে মাদকের অভিশপ্ত নীল নেশার আগ্রাসন এখন সর্বব্যাপী। ভয়ানক মাদকাসক্তি আমাদের তারুণ্য, মেধা, বিবেক, শিক্ষা, মনুষ্যত্ব, প্রেমপ্রীতি, পারিবারিক বন্ধন সব কিছুই ধ্বংস করে দিচ্ছে। মাদকসেবী সন্তান নিজের মা-বাবাকে পর্যন্ত খুন করতে দ্বিধা করছে না। একটি পরিবারকে ধ্বংস আর বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়ার জন্য একজন মাদকাসক্ত সদস্যই যথেষ্ট। মাদকাসক্তি মানুষের হিতাহিত জ্ঞান বা চেতনাবোধকে একেবারে নষ্ট করে দেয় একারণে দেখা যায়, মাদকাসক্ত বাবা মাদক সংগ্রহ করতে না পেরে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে অবলীলায় সন্তানকে হত্যা করছে। নেশার অর্থ জোগাড় করতে না পারায় স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা, প্রিয় সন্তান বেচে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। মাদকের নেশায় উন্মাদ সন্তান জন্মদাত্রীকে গলা কেটে হত্যা করার চরম বর্বরোচিত ঘটনাও ঘটছে আমাদের দেশে।
মদ, গাজা, হেরোইন ইত্যাদি মাদক দ্রব্য মানুষের মানুষের মুড বা মেজাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে এক ধরনের মাদকতা বা ভাবাবেগ তৈরি করে। এর ফলে তারা বাস্তবতাবোধ হারিয়ে ফেলে নিজেকে রাজা-মহারাজা মনে করে। এতে তারা সাময়িকভাবে হয়তো সুখ অনুভব করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব ক্রিয়ারই একটি বিরূপ বা প্রতিকূল প্রভাব থাকে। মাদকের বেলাও তাই। মানুষের মনের উপর মাদকদ্রব্যের অযাচিত এই হস্তক্ষেপের ফলে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। স্বল্পমেয়াদী প্রতিক্রিয়ায় মাদকগ্রহণকারী সাময়িক ভাবে মাদকতা বা সুখ অনুভব করলেও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়াটি হয় অত্যন্ত মারাত্মক। কেননা, মস্তিষ্কের যে অংশ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে, মাদকের বিষাক্ত কেমিকেল মস্তিষ্কের সেই অংশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে যা হয় দীর্ঘমেয়াদি এবং মারাত্মক। ফলে সেই অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট অন্য অংশকে সঠিক বার্তা দিতে পারে না বা ভুল বার্তা প্রেরণ করে। এভাবে এক সময় সেই অংশ তার সঠিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং এভাবে মাদকাসক্তির কারণে অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ একটি তরুণ শেষ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগীতে পরিণত হয়।
মানসিক রোগ হল এক ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীনতা। একজন সুস্থ মানুষ যেখানে জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখে এবং ইতিবাচকভাবে চিন্তা করে, সেখানে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি জীবনকে দেখে উল্টোভাবে এবং সবকিছুকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে দেখে থাকে- যা সমস্যা সৃষ্টি করে এবং জীবনকে সুখি করার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। নানা কারণেই মানসিক রোগ হতে পারে। তবে অন্যতম প্রধান কারণ হল এই মাদকাসক্তি।
মাদক আসক্তির মত মোবাইল আসক্তিও একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। মোবাইল আসক্তি বলতে মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত নেতিবাচক ব্যবহারকে বুঝাচ্ছি। বিশেষ করে তরুণ সমাজ গেম, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব সহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় আকৃষ্ট হয়ে এতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। একটি মোবাইল আসক্ত ছেলে বা মেয়ে সারাদিন যে পরিমাণ সময় মোবাইলের পেছনে ব্যয় করে তার ১০ ভাগের এক ভাগও পড়াশোনার পেছনে ব্যয় করে না। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে মোবাইল আসক্তিকেও একটি মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মাদকাসক্তির মত মোবাইল আসক্তির ফলেও বাস্তবতাবোধ, হিতাহিত জ্ঞান এবং শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা লোপ পায়।
আমাদের দেশ ও সমাজে বিদ্যমান এতসব প্রতিবেশ ও প্রতিবন্ধকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সন্তানকে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা যোগায় পরিবার এবং প্যারেন্টিং। বিশেষ করে নৈতিকতা শিক্ষার জায়গাগুলো যখন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, আর চরিত্র হননের বহুমুখি কৌশল অক্টোপাশের মতো আমাদেরকে ঘিরে ধরছে, তখন পরিবারকেই নৈতিকতার গুণাবলী সম্পন্ন সৎ মানুষ গড়ার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষ করে সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানে সচেষ্ট হতে হবে, কেননা, ধর্মীয় শিক্ষাই হচ্ছে নৈতিকতা শিক্ষার মূল ভিত্তি।
এ প্রসঙ্গে জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, ‘ধর্ম ছাড়া নৈতিক শিক্ষা শিকড় ছাড়া গাছের মত।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘‘তুমি যদি পৃথিবীর সব বিদ্যায় বুৎপন্ন হয়, অথচ নিজ ধর্ম সম্পর্কে না জানো, তাহলে তুমি মূর্খ।’’
দার্শনিক স্যার স্ট্যানলি হুল (Sir Stanely Hull) যথার্থই বলেছেন- If you teach your child theree Rs: Reading, Writing and Arithmatic and leave the forth R- Religion you will get fifth R- Rascality. 
জন মিল্টন বলেছেন- Education is harmonious development of body, mind and soul. অর্থাৎ-দেহ, মন ও আত্মার সমনি¦ত বিকাশ সাধনের নামই শিক্ষা।’’
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃত আলবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein) বিশ্বাস করতেন যে, বিজ্ঞান ধর্মহীন হতে পারে না। তিনি ঘোষণা করেন, ‘‘ধর্মহীন বিজ্ঞান পঙ্গু (বা অসম্পূর্ণ)।’’
প্যারেন্টিং এমন একটি বিষয় যা সমাজ মানস গঠনের মূল জায়গাটিতে অবস্থান করে। এটি এমন একটি শব্দ যার পরিধি যুগের চাহিদার সাথে সাথে পরিবর্তনশাল। কিন্তু এর ভিত্তিটি চিরন্তন।
চলবে-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন