বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৯

পরিবার ও প্যারেন্টিং: জাতিগঠনের মূল সূত্র [৩]


বস্তুত, পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে, বাবার চেয়ে আপন ও শুভাকাক্সক্ষী আর কেউ নেই। মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর তার অন্নদা মঙ্গল কাব্যে সন্তানের কল্যাণ কামনা করে বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ তাঁর এই আশীর্বাদ যেন চিরন্তন মা-বাবার আশীর্বাদ হয়ে কাল থেকে কালান্তরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আজও আমাদের অন্তর ছুঁয়ে যায়। কিন্তু এত যে প্রিয় সন্তান সেই এক সময় মমতাময়ী মায়ের বুকে, দয়ালু বাবার বুকে ছুরি বসায়। আর এজন্য একতরফাভাবে শুধু সন্তানদেরকে দায়ি করার সুযোগও কিন্তু আমাদের নেই।

আমরা প্যারেন্টরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বৈধ-অবৈধ বাছ-বিচার না করে অর্থ উপার্জনের নেশায় পাগল হয়ে যাই। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনের সূরা তাকাসূরের হেদায়াত এখানে উল্লেখ করা যায়, যাতে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন: ‘একে অন্যের চেয়ে বেশি (দুনিয়া) পাওয়ার ধান্দা করতে করতেই তোমরা কবওে পৌঁছে যাও।’ 

সত্যিই। সম্পদের নেশায় আমরা অন্ধ হয়ে যাই, কিন্তু একবারও চিন্তা করি না এত সম্পদ দিয়ে আমরা কী করব। আল্লাহ’র নবী এ বিষয়টি চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। হাদীসটি এ মুহূর্তে হুবুহু মনে নেই, তবে সারমর্ এরকম: দুনিয়াটি হল একটি মরা উট বা গরুর মত। একটি কুকুর কখনও একটি আস্ত মরা গরু একা খেয়ে শেষ করতে পারে না। কিন্তু তারপরও সে অন্য কুকুরকে মরা গরুটির ধারে কাছেও ঘেষতে দিতে চায় না। আমাদের কিছু মানুষের অবস্থাও ঠিক একই রকম। কিছু মানুষ এমনভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে যা তার বা তার পরিবারের লোকেরা খেয়ে শেষ করতে পারবে না; কিন্তু তারপরও তার খাই খাই যেন সবার চেয়ে বেশি। আর অত্যাধিক সম্পদের লোভ ও প্রাচুর্য মানুষকে ভোগবাদ, দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতার দিকে টেনে নিতে পারে।

অনেক সময় ছেলে-মেয়েদের প্রতি অত্যাধিক ভালোবাসার কারণেও মানুষ অর্থবিত্তের পাহাড় গড়তে চায় এবং হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দুর্নীতির পথে পা বাড়ায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে, যাদের জন্য সে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে সেই সন্তান-সন্ততি ও আপন জনেরা কিন্তু দুর্নীতিবাজ পিতা-মাতা বা আত্মীয়কে কখনও মন থেকে সম্মান করতে পারে না বরং মনে মনে ঘৃণা করে। সমাজ ও মানুষের ঘৃণাই হচ্ছে এসব লোকদের ভাগ্যলিপি।

সন্তান-সন্ততির নিকট পিতা-মাতার স্থান অতি উচ্চে। তারাই হচ্ছে সন্তানদের কাছে সবচেয়ে বড় আদর্শ। তাই পিতা-মাতার পদস্খলনে সন্তানেরা বড় ধরনের হোচট খায়, দুঃখ পায় এবং তাদের সামনে থেকে আদর্শের আলোক-উৎসটি সরে যায়। তখন গভীর হতাশা তাদের ঘিরে ধরে। এ বিষয়টি পিতা-মাতাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। সুতরাং পিতা-মাতাদের সতর্ক ও দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখা উচিত, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অপরাধপ্রবণ নয়। বরং স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ ন্যায়ের উপরই থাকতে চায়, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাই তাকে অপরাধ প্রবণ করে তোলে। কোমলমতি শিশু-কিশোর-তরুণদের জন্য একথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে পিতামাতার বিরাট দায়বদ্ধতা রয়েছে।

সুতরাং, শুধু হিতোপদেশ নয়, সন্তানদেরকে শেখাতে হবে কাজের মাধ্যমে। পিতা-মাতাকে হতে হবে আদর্শের রোল মডেল। শুধু অর্থোপার্জন ও নামি-দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করানোই সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের একমাত্র কাজ বা দায়িত্ব হতে পারেন না। বরং শিশুকে বিবেকবান, মহৎ চরিত্রের অধিকারী আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাটাই প্রধান দায়িত্ব।

আল্লাহ বলেছেন: ‘ হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে রক্ষা কর অগুন হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয় কঠোর স্বভাবের মালাইকা (ফেরেশতা), যারা অমান্য করেনা আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন তা এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তা’ই করে। ’ - ( সুরা আত তাহ্রীম )

রাসুল (সাঃ) বলেছেন:  মানুষ যখন মরে যায় তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমলের উপকার সে কেয়ামত পর্যন্ত পেতে থাকে। (১) সদকায়ে জারিয়া (২) এমন জ্ঞান যা সে বিতরণ করেছে এবং (৩) নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করবে। ( মুসলিম, মিশকাত )

‘নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার প্রতিপালকের, তোমার শরীরের, তোমার সন্তানের হক রয়েছে, অতএব হকদারকে তার হক প্রদান কর।’ - ( সাহীহ্ বুখারী )
‘আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা নিজেদের সন্তানদের সাথে কোমল ব্যবহার করো এবং তাদের উত্তম শিক্ষা ও ট্রেনিং প্রদান করো।’ -( ইবনে মাজাহ্ )

চলবে-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন