শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সমাজসেবা ও সামাজিক সংগঠনের গুরুত্ব

‘‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল রাখে।এমনকি তোমরা কবর পর্যন্ত পৌছে যাও।’’ -সূরা তাক্বাসুর, আয়াত: ১-২



আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরের একটু বেশি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে,  আমাদের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৬ বছর।এর মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছরই চলে যায় ক্যারিয়ার গঠনের পেছনে।গড়ে আমাদের কর্মজীবন শুরু হয় ত্রিশ বছর বয়স থেকে।আর গড়ে আমাদের জীবনে বার্ধক্য বা অবসরে যাওয়ার সময় চলে আসে ৬০ বছর বয়সেই।তাই বলা যায়, আমরা মূলতঃ ভালভাবে কাজ করার সময় পাই ত্রিশ থেকে ৩৫ বছর।আর এই ৩০-৩৫ বছরের কর্মজীবনে আমরা যত কাজ করি তার প্রায় পুরোটাই দুনিয়ার জন্য।অর্থাৎ পার্থিব জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করার সংগ্রাম করতে করতেই আমাদের কবরে চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়।অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনের বিত্ত-বৈভব, বাড়ি-গাড়ী, ব্যাংক-ব্যালেন্স, সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্যই আমরা যতটা ব্যাতি-ব্যস্ত থাকি; এজন্য যতটা সময় ব্যস্ত থাকি তার একশো ভাগের এক ভাগও আমরা আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য ভাবি না বা এ বিষয়টি আমাদের স্মরণেই আসে না।অথচ আখেরাতের জীবনের তুলনায় আমাদের এই পার্থিব জীবন নিতান্তই তুচ্ছ।আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের নগণ্যতা বুঝাতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, পরকালের তুলনায় দুনিয়ার উপমা শুধু এতটুকুই যেমন তোমাদের মাঝে কেউ নিজের একটি অঙ্গুলি সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে তুলে নিল। অতঃপর দেখ তাতে কতটুকু পানি লেগে এসেছে।’ -সহিহ মুসলিম শরিফ।

আসলে পরকালের জীবনই আসল জীবন। যে জীবনের শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।অথচ আখেরাতের সেই অনন্ত জীবনের জন্য ভাবনার সময় আমাদের নেই।আমরা রাত-দিন দুনিয়ার পিছনেই ছুটছি। এমনকি সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে আমরা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াই তখনও আল্লাহকে আমরা খুব কমই স্মরণ করি, নামাজের মধ্যেও দুনিয়ার চিন্তাই আমাদেরকে অস্থির করে রাখে।আর এই দুনিয়ার ধান্দা করতে করতেই যখন আমাদের প্রভূর কাছে ফিরে যাওয়ার ডাক আসে তখন দুনিয়ার এই সব বিত্ত-বৈভব সব কিছু মাটির উপরে রেখে আমাদেরকে মাটির নীচে চলে যেতে হয়।তখন দুনিয়ার কিছুই আমাদের সাথে যায় না, যায় শুধু আমাদের আমল।নেক বা বদ যে আমলই আমরা দুনিয়ায় করেছি তাই আমাদের সাথে যাবে। এ কারণেই বলা হয় ‘দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।’ এখানে যে আমল আমরা করেছি আখেরাতের অনন্ত জীবনে তাই আমাদের ভোগ করতে হবে।

আসলে দুনিয়ার এই ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগী আখেরাতের অনন্ত জীন্দেগীর কামিয়াবির জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র মাত্র।আর মৃত্যুর মাধ্যমে এই পরীক্ষা ও মানুষের দুনিয়ার জিন্দেগীর অবসান ঘটে।পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে গেলে যেমন আর উত্তর লেখার সুযোগ থাকে না, তেমনি মৃত্যু এসে গেলে আর আমলের সুযোগ থাকে না।মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুনিয়ার জীন্দেগীর অবসান হয় এবং একই সাথে আখেরাতের অনন্ত জীবনের যাত্রা শুরু হয়।

সদকায়ে জারিয়া

তবে এমন কিছু আমল আছে, যা জীবদ্দশায় করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব ও উপকারিতার ধারা অব্যাহত থাকে। এগুলোকে সদকায়ে জারিয়া বলে।

‘সদকা’ শব্দের অর্থ দান করা। আর ‘জারিয়া’ অর্থ অব্যাহত। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে সমাজ ও মানুষের কল্যাণে এমন কাজ করে যাওয়া যা ব্যক্তির মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকে।

সদকায়ে জারিয়ার কারণে মৃত্যুর পরও দানকারীর ‘সওয়াব সঞ্চয়’ সমৃদ্ধ হতে থাকে। এর স্রোতধারা তার ‘পুণ্য তরি’কে চলমান রাখে। এটা আল্লাহতায়ালার বিশেষ নিয়ামত ও রহমত। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমলের ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট কিছু আমল করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব জারি থাকে। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের জন্য সওয়াব পৌঁছার ব্যবস্থা করে যেতে পারে এবং চাইলে তার জারি করা ভাল কাজের কারণে উপকারভোগী অন্য মানুষের মাধ্যমেও তার নেক আমলের পাল্লা ভারি হতে পারে।এ উভয় পদ্ধতিই আল্লাহতায়ালার একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ।

সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের গুরুত্ব

কথায় আছে: দশের লাঠি একের বোঝা, দশে মিললে কাজ সোজা।

আমরা অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে দান বা সদকাহ করে থাকি। তবে ব্যক্তির সক্ষমতার সব সময়ই একটি সীমা থাকে। আবার সব ব্যক্তির সামর্থও একরকম থাকে না। সামর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ব্যক্তির মধ্যে জনসেবার মানসিকতা ও মেধা থাকা সত্ত্বে তারা তা কাজে লাগাতে পারেন না, যা সমবেত উদ্যোগের মাধ্যমে সহজেই করা যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, দানশীল ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার তৎপরতারও অবসান হয়।অবশ্য তিনি যদি মানবসেবার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান রেখে যান তখন তা দীর্ঘ সময় টিকে থাকে।

তাই সকলের সীমিত সামর্থ ও উদ্যোগের সমবায়ে সহজেই একটি বৃহত্তর সক্ষমতা গড়ে তোলা যায় যা সামাজিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাপক ব্যাপ্তি নিয়ে কাজ করতে পারে, যেখানে সকলেই নিজ নিজ সামর্থ ও মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পায়।

আবার সামাজিক সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের মাধ্যমে নতুন নতুন দানশীল ব্যক্তি, সংগঠক ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও সম্ভব হয় যার মাধ্যমে সৎকাজ বা নেক আমলের একটি ধারাবাহিকতাও জারি থাকে।

ভাল কাজ করার জন্য আপনার সদিচ্ছাই যথেষ্ট

আমরা এখানে মূলত ফান্ডের বিষয়টি নিয়েই কথা বলবো। যাদের পর্যাপ্ত এককালীন ফান্ড নাই কিন্তু ইচ্ছা আছে, তাদের সামনে প্রচলিত উপায় হলো ২টিঃ ১. লোন করা, ২. সঞ্চয় করা।

লোন করলে তা শোধ করার একটা দায় থাকে। লোন শোধ করার আগে যদি মৃত্যু হয় তাহলে আরেক বিপদ। লোন নিয়ে মারা গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

এখন আসি সঞ্চয়ের কথায়। প্রথমত, ব্যাংকে দীর্ঘ মেয়াদে ডিপিএস করা যায়। যেমনঃ ১০, ১৫ বা ২০ বছর। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদের ডিপিএস করলে কিস্তির টাকার পরিমান কম ও সহনিয় হয়।প্রফিটও বেশি হয়। কিন্তু ব্যাংকে এত দীর্ঘ মেয়াদের ডিপিএস করলে আপনাকে অবশ্যই মেয়াদ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে। কারন, মেয়াদ পূরতির আগে মারা গেলে আপনার কাংখিত মূলধন গঠন হবেনা এবং আপনার সপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।

সঞ্চয়ের আরেকটি মাধ্যম হলো লাইফ ইন্সুইরেন্স।লাইফ ইন্সুইরেন্স-এ দীর্ঘ মেয়াদের ডিপিএস বা মেয়াদি বীমার সুযোগ রয়েছে যেখানে আপনি মাসিক, ষান্মাসিক কিংবা বাৎষরিক কিস্তিতে টাকা জমা দিতে পারেন। ইন্সুইরেন্সে সুবিধা হলো, মেয়াদ শেষে আপনি তো প্রফিটসহ আপনার আমানতের টাকা ফেরত পাবেন; যা দিয়ে আপনি নিজেই একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান করতে পারবেন যা আপনার মৃত্যুর পরও সদকায়ে জারিয়া হিসেবে কাজ করবে।আবার (আল্লাহ না করুন) মেয়াদ পূরতির আগে মারা গেলেও আপনার সপ্ন পূর্ণ হতে কোন বাধা থাকবে না। কারণ, সেক্ষেত্রে কোম্পানি আপনার নোমনীকে পূর্ণ মেয়াদের টাকা প্রফিটসহ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।আপনি যদি ২০ বছর মেয়াদী বীমা করে মাত্র একটি কিস্তি দিয়েও মারা যান বা দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান তাহলেও কোম্পানী আপনার মোনোনীত নোমিনীকে (ব্যক্তি বা প্রতিসঠান) পূর্ণ মেয়াদের বীমা দাবির টাকা প্রদান করবে যারা আপনার ওসিয়ত অনুসারে মানব সেবা বা শিক্ষা বিস্তারের জন্য কোন ফাউন্ডেশন বা প্রতিসঠান করতে পারবেন যার সওয়াব সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আপনার আমলনামায় যোগ হতে থাকবে। 

তবে ব্যাংক হোক কিংবা লাইফ ইন্স্যুরেন্স- উভয়ের ক্ষেত্রেই শর্ত হোলো, কোম্পানিটিকে অবশ্যই সূদমুক্ত ইসলামী প্রতিষ্ঠান হতে হবে।কারণ, সূদের টাকায় ইসলামী প্রতিষ্ঠান করা যায় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন