নবী-রাসূলদের বিশেষত্ব এখানে যে, তাদের কাছে আল্লাহর কালাম প্রেরিত হ’ত যা সাধারণ মানুষের কাছে হ’ত না। আল্লাহ বলেছেন :
‘হে মুহাম্মাদ (সঃ), বলে দাও, আমি তোমাদের মতই একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। তবে (পার্থক্য এই যে,) আমার কাছে অহী অবতীর্ণ হয়।’ Ñ[কাহাফ : ১১০]
নবী-রাসূলদের কাজ ছিল এই অহী বা আল্লাহর বাণীকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ কারণে আল কোরআনে নবী-রাসূলদেরকে আল কোরআনে বাণীবাহক বা বার্তাবাহকও বলা হয়েছে। আল্লাহর বাণী, তাঁর হুকুম, বিধান বা পথ-নির্দেশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া বা আল্লাহর কালামের শিক্ষাকে মানুষের সমাজে প্রচার করাই ছিল নবী-রাসূলদের কাজ। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এরও প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল আল্লাহর কালাম আল কোরআনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং কোরআনের শিক্ষার দিকে মানুষকে আহবান জানানো।
মূলত আল্লাহর দিকে আহবান করা বলতে কিন্তু আল্লাহর কালামের দিকে, আল্লাহর হুকুম-আহকাম ও তাঁর হেদায়াতের দিকে মানুষকে আহবান করাকেই বুঝায়। তাই মহানবীর জীবনের অন্যতম প্রধান মিশন ছিল আল কোরআনের প্রচার করা, আল্লাহর কালামকে যথাযথভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন :
‘হে রাসূল! তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যথাযথভাবে প্রচার কর। যদি তা না কর, তাহলে তো তুমি আল্লাহর রিসালাতকে পৌঁছালে না।’ Ñ[আল মায়েদা : ৬৭]
‘হে চাদর আবৃত্ত শয্যাগ্রহণকারী, ওঠো, সাবধান কর, আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। -[মুদ্দাস্সির : ১-৩]
মহানবীর এই মিশন সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আরো বলেছেন :
‘তিনিই উম্মিদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল রূপে প্রেরণ করেছেন; যে তাদেরকে তাঁর আয়াত আবৃত্তি করে শোনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও কৌশল শিক্ষা দেয়। ইতিপূর্বে তো এরা ঘোর বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’Ñ[জুমু’আ : ২]
‘তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ মোমেনদের প্রতি অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন। সে তাঁর (আল্লাহর) আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করে শোনায়, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। এর পূর্বে তো তারা সুস্পষ্ট গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।’-[আলে ইমরান : ১৬৪]
‘(বল) আর এ কোরআন আমার প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যেন এর দ্বারা তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এটি পৌঁছবে তাদের সবাইকে সাবধান করে দিতে পারি।’-[আনআ’ম : ১৯]
‘প্রচার করাই রাসূলের কর্তব্য। তোমরা যা প্রকাশ কর এবং গোপন কর সে সম্পর্কে আল্লাহ জানেন।’-[আল মায়েদা : ৯৯]
‘কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার উপর ফোরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) নাযিল করেছেন, যাতে সে বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারী হতে পারে।’-[ ফোরকান : ১]
‘এ কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি, এটি বরকতপূর্ণ। এতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং নিষিদ্ধ সীমা পরিহার করে চল। তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।’-[আল আনআম : ১৫৫]
‘(হে নবী!) এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন বুদ্ধিমান লোকেরা একে গভীর ভাবে অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা করে।’ -[আস সোয়াদ : ২৯]
‘তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাক্সক্ষা ছাড়া আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছু নেই।’ -[আল বাকারা : ৭৮]
‘আমি তোমার প্রতি আমার জিকির (আল কোরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বর্ণনা করতে পারো, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।’
এমনিভাবে পবিত্র কোরআন মজিদের আরো অসংখ্য আয়াত উদ্ধৃত করা যায়, যাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোরআন প্রচার করা, মানুষের কাছে আল্লাহর কালাম পৌঁছে দেয়া, তাদেরকে কোরআন মজিদ তেলাওয়াত করে শোনানো, এর বিষয়বস্তু ও শিক্ষা তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া, এর আলোকে মানুষকে কর্ম-কৌশল ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তোলা, কোরআনের শিক্ষার আলোকে মানুষের মধ্যে বিরাজমান অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও গোমরাহি দূর করা এবং তাদেরকে সতর্ক ও সচেতন করে তোলা ছিল আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) নবুয়তী দায়িত্ব।
ঈমানদারদের উদ্দেশ্যেও দায়ী ইলাল্লাহর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন :
‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করে, সৎ কাজ করে আর ঘোষণা করে যে আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’-[হা-মীম-আস্সাজদা : ৩৩]
আল্লাহর নবী এবং সাহাবায়ে কেরাম তাই নিজেদের জীবনে কোরআন প্রচারের এ কাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলেন। কারণ আল্লাহর কালাম আল কোরআন হল আল্লাহর নৈকট্য ও হেদায়াতের সেই ফল্গুধারা, সেই সিরাতুল মুস্তাক্বিম; সূরা ফাতিহার মুনাজাতের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়তই যার প্রার্থনা করে থাকি।
প্রতি ওয়াক্ত নামাজের প্রতি রাকায়াতেই আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে থাকি -‘আমাদেরকে সহজ-সঠিক পথে পরিচালিত কর। সে সব লোকের পথ যাদেরকে তুমি পুরুষ্কৃত করেছো; তাদের পথ নয়, যারা পথভ্রষ্ট ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
বস্তুত, আল ফাতিহার প্রার্থনার জবাবই হচ্ছে সমগ্র আল কোরআন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই আমাদেরকে এ প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়েছেন এবং আবার তিনিই আমাদেরকে আমাদের প্রার্থীত সিরাতুল মুস্তাক্বিম পথের দিশা দিয়ে ধন্য করেছেন।
আবার আল কোরআনের এই ঐশী হেদায়াত মূলত সেই শাশ্বত পথ; যে পথের সুসংবাদ আল্লাহ তায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় দিয়েছিলেন।
আদিপিতা হযরত আদম (আঃ)-কে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছিলেন, যুগে যুগে তাঁর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে ঐশী পথ-নির্দেশ বা জীবন বিধান পাঠানো হবে। যারা সেই হেদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের জন্য ভয় ও বিপদের কোন কারণ থাকবে না।
কিন্তু যারা আল্লাহর দেয়া সেই জীবন-বিধানের বিরোধিতা করবে, তারাই হবে বিভ্রান্ত ও ব্যর্থ। তাদের জন্য রয়েছে বিপর্যয় ধ্বংস। পবিত্র কালামে মজিদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন এভাবে :
‘তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর আমার পক্ষ থেকে যে জীবন-বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছানো হবে; যারা সে বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য কোন ভয় ও চিন্তার কোন কারণ থাকবে না। আর যারা সে বিধান গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে এবং আমার বাণী ও আদেশ-নিষেধকে মিথ্যা গণ্য করবে, তারা নিশ্চয় জাহান্নামী হবে এবং তারা সেখানে চিবদিন থাকবে।’ -[আল বাকারা : ৩৮-৩৯]
সুতরাং আল্লাহর কালাম আল কোরআনই হল মুক্তির একমাত্র পথ। আল্লাহর দেয়া হেদায়াতই তাঁর নৈকট্য বা খোদাপ্রাপ্তির যথার্থ সিরাতুল মুস্তাক্বিম। আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ বা ওসিলা তালাশ করতে হলে আমাদেরকে তাই কোরআনের পথের দিকেই ফিরে আসতে হবে।
কারণ এ পথই ঈমানের পথ, এ পথই হেদায়াতের পথ। এ পথই নির্ভেজাল জ্ঞান ও সত্যের পথ। কোন বুযুর্গ ও কোন বাবার পাও ধরা এ পথের বিকল্প হতে পারে না। আল্লাহ কথার চেয়ে কোন মানুষের কথাকে বড় মনে করলে কেবল শয়তানের সান্নিধ্যই লাভ হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য ও হেদায়াত তাতে কখনো লাভ হতে পারে না।
যারা মনে করে আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পন না করে কোন পীর-মাশায়েখ বা তথাকথিত বুযুর্গ ব্যক্তিদের পা ধরে পরে থাকলেই নাযাত পাওয়া যাবে তারা মূলত ঐসব ব্যক্তিদেরকেই খোদার আসনে বসিয়ে দেয়। কারণ কোন মানুষ কখনো অপর মানুষের প্রভু হুকুমকর্তা হতে পারে না, নিরংকুশ আনুগত্য বা গোলামী দাবী করতে পারে না। যারা এসব করে তারা পরিষ্কার শিরক ও পৌত্তলিকতার মধ্যে নিমজ্জিত। কারণ এসব কর্মকা- তাওহীদের শাশ্বত আদর্শ ও ঈমানী চেতনার পরিপন্থী। যারা এসব কাজে লিপ্ত তারা পরিষ্কার বিভ্রান্তি ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত।
সূরা আসরে পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে যে, দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা বা কামিয়াবী নির্ভর করছে চারটি জিনিসের উপর। ১. ঈমান, ২. আল্লাহর হুকুম পালন বা নেক আমল, ৩. হকের দাওয়াত বা ইসলামের প্রচার এবং ৪. সবর বা ধৈর্য ও সহনশীলতার নীতি। বলা হয়েছে সত্যের এ চারটি মূলনীতি থেকে যারা বিচ্যূত হয়েছে তারাই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। অতীতে যারা এ পথ থেকে বিচ্যূত হয়েছিল তারা যেমন ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত ছিল; বর্তমানেও যারা ঈমানদারী, আল্লাহর হুকুম পালন এবং সহনশীলতার নীতি হকের দাওয়াতের পথ থেকে বিচ্যূত হয়েছে তারাও সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ও ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত এবং ভবিষ্যতেও যা এ পথ থেকে বিচ্যূত হবে ও তারাও ক্ষতির মধ্যেই নিমজ্জিত থাকবে। আর এ ক্ষতি হল দুনিয়া ও আখেরাতেরই চরম ক্ষতি।
বস্তুত, পৃথিবীতে আল্লাহর কালামই হচ্ছে পরম সত্য ও নিরংকুশ জ্ঞানের উৎস। কোন ধরনের বিভ্রান্তি, ভুল চিন্তা, ভুল মত, কোন ধরনের অসম্পূর্ণতা ও অসঙ্গতি এতে নেই। সামান্য সন্দেহ-সংশয় বা অনুমান নির্ভর কোন কথাও এতে বলা হয়নি। মিথ্যা ও বিভ্রান্তি থেকে আল্লাহর কালাম সর্বতোভাবে মুক্ত ও পবিত্র।
এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে আল্লাহ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন :
‘যারা জ্ঞানবান মানুষ, তারা তোমার প্রতি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এ গ্রন্থ সম্পর্কে মনে করে যে, এ গ্রন্থই হচ্ছে সত্য, এটি মানুষকে পরাক্রান্ত ও প্রশংসিত প্রভুর দিকেই নিয়ে যায়।’ Ñ[সাবা : ৬]
বস্তুত, আল কোরআনের সাথে কোন মানুষের কথা তুলনীয় হতে পারে না। কারণ আল্লাহ তায়ালাই বলে দিচ্ছেন এভাবে :
‘হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, যিনি আসমান ও জমিনের সকল রহস্য জানেন এ কিতাব তিনিই নাযিল করেছেন। তিনি ক্ষমাশীল, মেহেরবান।’ -[ফুরকান : ৬]
‘নিশ্চিতরূপে এ এক সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত কিতাব। মিথ্যা না এর সামনে থেকে আসতে পারে আর না পেছন থেকে। এ এক প্রাজ্ঞ ও প্রশংসিত সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। -[হা-মীম-আস সিজদাহ : ৪১]
‘এ কিতাবে কোন কথাই সন্দেহের ভিত্তিতে বলা হয়নি।’ -[বাকারা : ২]
বস্তুত, আল্লাহর কালাম বা তাঁর প্রত্যাদেশ ও হুকুমের চেয়ে পৃথিবীর কোন মানুষের কথা, মতবাদ অথবা নির্দেশ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। সেই ব্যক্তি যত বড় প্রভাবশালী বা ক্ষমতাধর কর্তৃপক্ষ হোন না কেন। এমনকি তিনি যদি কোন ধর্মীয় নেতা বা কর্তৃপক্ষও হন তাহলেও তার বয়ান বা বাণীকে আল্লাহর কালামের উর্ধে স্থান দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ আল্লাহর বাণীর চেয়ে বান্দার বাণী বা বয়ানকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ নেই; তা তিনি যত বড় নেতা, যত বড় পীর বা বুযুর্গই হোন না কেন। ইসলাম ধর্ম মতে সকল ধরনের পবিত্রতা ও প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। কারণ কেবলমাত্র তিনিই এর যোগ্য, অন্য কেউ নয়। এটিই আল কোরআনে বর্ণিত তাওহীদ বা একত্ববাদের মূলকথা। ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা সর্বাবস্থায় ঈমানের এ চেতনাকে লালন করেন এবং এ থেকে তারা কখনো বিচ্যূত হন না।
আল্লাহর কালাম থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য কিছু বিভ্রান্ত অথচ লেবাসধারী লোক আল কোরআন সম্পর্কে মানুষকে অহেতুক আতংকিত করে তুলছে। তারা একে অত্যন্ত জটিল অস্পৃশ্য গ্রন্থ বলে বর্ণনা করে এ গ্রন্থোর অর্থ জানা থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করে। যেমনটি করতো কুরাইশ মুশরিকেরা। তারা কোরআন সম্পর্কে নানা অপপ্রচার করে বেড়াতো যাতে লোকেরা কোরআন না শোনে। কারণ কোরআন শুনলেই লোকেরা কোরআনের কথায় আকৃষ্ট হতো।
এক সময় খ্রিস্টান পাদ্রী-পুরোহিতরা ধর্মগ্রন্থ পাঠ থেকে লোকদেরকে বিরত রাখতো। হিন্দু-ব্রাহ্মণগণও এ কাজটি করতো। তারা বাংলা ভাষায় ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদকে নিষিদ্ধ করেছিলো। যারা মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করার চেষ্টা করতো তাদেরকে রৌরব নরকের ভয় দেখানো হত। এসবেরই উদ্দেশ্য ছিল ঐশী আদর্শের পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মতকে প্রাধান্য দেয়া। আল্লাহর কথার চেয়ে নিজেদের কথাকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই কোরআনের কথাকে অত্যন্ত কঠিন, জটিল ও বোধগম্যহীন বলে বর্ণনা করে এর অর্থ জানা থেকে লোকদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ আল কোরআন হচ্ছে বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই আল্লাহ প্রদত্ত এক সুস্পষ্ট হেদায়াত বা পথ-নির্দেশ। আল্লাহ বলেন :
‘নিঃসন্দেহে এ কোরআন এমন পথ প্রদর্শন করে, যা একেবারেই সহজ-সরল।’ -[বনি ইসরাইল : ৯]
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে এসব বৈরী প্রচারণা এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি নিস্পৃহতার কারণে আমাদের সমাজে কোরআনের শিক্ষা জানার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখা যায় না, কোরআন পড়া হয় শুধু তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে। অথচ যে কোন গ্রন্থ পড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই গ্রন্থে যা বলা হয়েছে তাকে জানার চেষ্টা করা।
আমরা যদি কোন গ্রন্থের শিক্ষাকে নিজেদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাহলে সে গ্রন্থের শিক্ষা জানার জন্যই আমরা তা পড়ে থাকি। গ্রন্থটি যদি এমন ভাষায় লিখিত হয়, যা আমরা জানি না, তাহলে আমরা গ্রন্থটির শিক্ষাকে অত্যন্ত জরুরী মনে করার কারণেই তার অনুবাদ জানার চেষ্টা করি।
কারণ অর্থ না জানলে গ্রন্থাকার কী বলতে চান তা আমরা কীভাবে বুঝব? আর কোন একটি বই পড়ে তা থেকে কোন কিছু জানতে ও বুঝতে যদি আমরা নাই পারি তাহলে সে গ্রন্থ পড়াকে আমরা অর্থহীন বলে থাকি। কোন সুস্থ ব্যক্তিই নিশ্চয়ই এমন আচরণ করেন না।
অর্থাৎ কেউ যদি নিয়মিতভাবে এমন একটি বই পড়ে যে বইটির ভাষা সে জানে না, গ্রন্থটি সে খুবই শুদ্ধ করে পড়তে পারে কিন্তু তার অর্থ কিছুই জানে না এবং জানার চেষ্টাও করে না অথচ সেই ব্যক্তি দাবী করে যে সে ঐ গ্রন্থের লেখককে খুবই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে আর একই ভাবে তার গ্রন্থটিকেও সে তার জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে; তাহলে ঐ ব্যক্তির এহেন আচরণে আমরা নিশ্চয়ই সন্দিহান হয়ে পড়ব যে, সে আসলে সুস্থ আছে কিনা!
অথবা তার এ সব আচরণকে আমরা পাগলামি ও হাস্যকর যে মনে করব তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। আর এই উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণের মাধ্যমে ঐ গ্রন্থ ও গ্রন্থ-প্রণেতার প্রতি পাঠকের শ্রদ্ধা, ভালোবাসার দাবীও যে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তাও নিশ্চয়ই আমরা চিন্তা করে দেখতে চাইব।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের সাথে কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত এ ধরণের উদ্ভট ও হাস্যকর আচরণই করে যাচ্ছি। আরবদের কাছে আল কোরআন তো কোন দুর্বোদ্ধ গ্রন্থ নয়। তারা তো কোরআন তেলাওয়াত করে এর অর্থ সহজেই বুঝতে পারতেন। যার কারণে আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং এর জন্য অশেষ সওয়াব প্রাপ্তির কথা বলেছেন। কারণ, বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করার কারণে কোরআনের শিক্ষা তাদের হৃদয়পটে গাথা হয়ে যেত। আর ইসলামী জিন্দেগী যাপনের জন্য এর অপরিহার্য প্রয়োজনও ছিল।
কিন্তু আমরা যারা আরবী ভাষা জানি না তারা যদি কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা না করে শুধু তেলাওয়াত করি তাহলে আমাদের কোরআন পড়ার হক কতটুকু আদায় হবে তা কি ভেবে দেখা উচিত নয়? আল্লাহ আমাদেরকে কোরআন পড়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা কি কোরআনের শিক্ষাকে জানা ও বুঝার জন্য নয়? আমরা যদি কোরআনের শিক্ষাকে না জানি তাহলে কোরআন থেকে হেদায়াত নেয়া আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে?
পবিত্র কোরআনের শিক্ষাকে জানা ও বুঝার কারণে দ্বীনের যে ধরনের বুঝ, যে ধরনের ঈমান ও উপলব্ধি তৈরি হওয়া সম্ভব তা কি অর্থ না জেনে তেলাওয়াতের মাধ্যমে, আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম সম্পর্কে বেখবর থাকার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব?
মোটেই সম্ভব নয়। কারণ স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনই এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, জ্ঞানী আর মূর্খের উপলব্ধি সমান নয়। আর জ্ঞানীরাই আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে, তারাই হেদায়াত থেকে বেশি উপকৃত হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন :
‘এটা কি করে সম্ভব হতে পারে যে, যে ব্যক্তি তোমার আল্লাহর এই কিতাবকে, যা তিনি তোমার প্রতি নাযিল করেছেন, সত্য বলে জানে আর যে ব্যক্তি এ মহাসত্য সম্পর্কে অজ্ঞ-অন্ধ তারা দুজনই সমান হতে পারে? উপদেশ তো বুদ্ধিমান লোকেরাই কবুল করে থাকে।’ -[রা’দ : ২০]
গুবহানাল্লাহ! কী দুর্ভাগ্য আমাদের! আল কোরআনের এমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও আজ আমরা উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করেছি! আল্লাহর কথার চেয়ে আজ আমরা তথাকথিত বুযুর্গদের কথাকেই যেন বেশি প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আল্লাহ বলছেন জানো, জানতে চেষ্টা কর! আর বুযুর্গ রূপী আযাযিল ওয়াসওয়াসা দিয়ে বলছে খবরদার, কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা ক’রো না, শুধু তেলাওয়াত কর, শুধু তেলাওয়াত...!
মহাগ্রন্থ আল কোরআন এসেছে কি শুধু না বুঝে তেলাওয়াতের জন্য? কিন্তু কোরআন যিনি পাঠিয়েছেন সেই পরওয়ার দিগার এ সম্পর্কে বলছেন -
‘এ কিতাব আমি অবতীর্ণ করেছি, এটি বরকতপূর্ণ। এতএব তোমরা এর অনুসরণ কর এবং নিষিদ্ধ সীমা পরিহার করে চল। তবেই তোমরা রহমত প্রাপ্ত হবে।’-[আল আনআম : ১৫৫]
‘(হে নবী!) এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন বুদ্ধিমান লোকেরা একে গভীর ভাবে অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা করে।’ Ñ[আস সোয়াদ : ২৯]
‘তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাক্সক্ষা ছাড়া আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছু নেই।’ Ñ[আল বাকারা : ৭৮]
‘আমি তোমার প্রতি আমার জিকির (আল কোরআন) অবতীর্ণ করেছি, যাতে লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বর্ণনা করতে পারো, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।’
আল্লাহ আমাদের মাফ করুন। আমরা প্রতিদিন, প্রতি ওয়াক্তে অত্যন্ত তাযিমের সাথে কোরআন তেলাওয়াত করি কিন্তু ভুলে একবারও আমাদের জানতে ইচ্ছে করে না এই পবিত্র বাণী গুলোতে আল্লাহ কী বলেছেন। আর ঠিক এ কারণেই নিরক্ষর লোকদের মতই আমরা আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে আন্দাজ-অনুমান, ধারণা-কল্পনা নির্ভর আকিদা-বিশ্বাস লালন করছি আর মিথ্যা আকাক্সক্ষার আশ্রয় নিয়ে অজ্ঞতা ও মূর্খতার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি।
মানসিক এই বৈকল্যের কারণেই আজ আমাদের চিন্তা-চেতনাও হয়ে গেছে পঙ্গু ও নি¯প্রাণ। এ কারণেই আমাদের ঈমান আজ চেতনাহীন। আল্লাহর কালাম আজ ভুলুণ্ঠিত। আল্লাহর হুকুম আজ বিজয়ী বেশে নেই। আল্লাহর হুকুম আজ মানুষের হুকুমের অধীন। আল্লাহর আইন আজ সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত নয়, ভুলুণ্ঠিত। আল্লাহর আইন আজ মানুষের আইনের অধীন। কোরআন এসেছে শাসন করার জন্য, শাসিত হওয়ার জন্য নয়। অথচ এ সম্পর্কে আজ আমাদের কোন চেতনাই নেই। আমাদের অন্তর আজ এতটাই মরে গেছে যে, এই কঠিন অন্তরের মধ্যে বোমা মারলেও যেন আর সম্বিত ফিরে আসবে না। অথচ আল্লাহ বলছেন:
‘আমরা যদি এই কোরআন কোন পাহাড়ের উপরও নাযিল করতাম, তাহলেও তুমি দেখতে যে সে পাহাড় আল্লাহর ভয়ে কেমন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে! এই দৃষ্টান্ত গুলো আমরা এ জন্য দেই, যেন লোকেরা নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে।’Ñ[আল হাশর : ২১]
আমাদের অন্তর ইহুদীদের মত এত কঠিন ও অভিশপ্ত হয়ে উঠল কীভাবে?
আল্লাহ বলছেন এই পবিত্র কালামকে যদি তিনি মানুষের উপর নাযিল না করে কোন নি¯প্রাণ পাহাড়ের উপরও নাযিল করতেন, তাহলে এই মহা নেয়ামতপূর্ণ কোরআনের ব্যাপারে দায়িত্বানুভূতি ও জবাবদিহির ভয়ে নি¯প্রাণ পাহাড়ও ক্রন্দন করে উঠতো, আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গলে গলে পড়তো।
অথচ আকল সম্পন্ন মানুষ তথা সৃষ্টির সেরা মানুষ হওয়া সত্তেও, আল্লাহর খলিফার পরিচয় ধারণ করা সত্তেও মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রতি আজ আমাদের যেন কোন দায়বদ্ধতা নেই, কোন দায়িত্বানুভূতি নেই।
এসবই ইহুদীদের এবং পতন যুগের জাতি সমূহের লক্ষণ। কোন জাতির অধঃপতন যখন ঘনিয়ে আসতো, তখন সে জাতির কায়েমী স্বার্থবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠী সমূহ আল্লাহর কালাম থেকে লোকদেরকে দূরে রাখার জন্য বিভিন্ন ভাবে ফন্দি-ফিকির করত। যার কারণে সে জাতির জীবন-প্রণালীর সাথে আল্লাহর কালামের আর কোন যোগসূত্র থাকতো না এবং এক সময় আল্লাহ তাঁর কালামকে ঐ অভিশপ্ত জাতির কাছ থেকে উঠিয়ে নিতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে আল্লাহর কালাম এক সময়ে সে সব জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং নানামুখি বিকৃতি ও অবহেলার শিকার হয়ে অবশেষে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু আল কোরআন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের সর্বশেষ কালাম হওয়ায় এটি কখনো বিকৃত ও বিলুপ্ত হবে না। কারণ সর্বশেষ কিতাব হওয়ার কারণে রাহমানির রাহিম নিজেই একে হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। যার কারণে আরবী ভাষা না জানা সত্তেও যে কোন অনারব এ মহাগ্রন্থটি অর্থ না বুঝে শুধু তেলাওয়াতের মাধ্যমেও অশেষ ফায়েয ও তৃপ্তি লাভ করে থাকেন, যা পৃথিবীর আর কোন গ্রন্থ পাঠে সম্ভব হয় না।
অর্থ না জেনে দুনিয়ার আর কোন গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠাও কেউ ক্লান্তিহীন ভাবে পাঠ করতে সক্ষম নয়। কারণ কাজটি অর্থহীন হওয়ার কারণে অশেষ বিরক্তি ও ক্লান্তি তাকে ঘিরে ধরবে। কিন্তু মহাগ্রন্থ আল কোরআনই এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থ যার শাব্দিক অর্থ না জানা সত্বেও লক্ষ কোটি মানুষ পরম আবেগ, আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে প্রতিদিন তেলাওয়াত করছে এবং আধ্যাত্মিক ভাবে অশেষ উপকৃত হচ্ছে।
এটি মূলত বরকতপূর্ণ এই ঐশীগ্রন্থের একটি মোজেজা, নতুবা শুধুমাত্র তেলাওয়াত করে সওয়াব কামাইয়ের জন্যই এ মহাগ্রন্থটি অবতীর্ণ হয়নি।
বরং আল কোরআন এসেছে মানুষের জীবন ও সমাজ-সভ্যতার মধ্য থেকে সকল ধরনের কুফরিকে বাতিল করে দিয়ে তার স্থলে হককে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, মূর্খতা ও জাহেলিয়াতের অন্ধকার ভেদ করে জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বোলিত করার জন্য। অজ্ঞতা ও নৈরাজ্যের ধ্বংসস্তুপের উপর সভ্যতার প্রাসাদ নির্মাণের জন্য। ইসলাম জীবনমুখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন বিধান। মূর্খতা ও বৈরাগ্যবাদের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই।
সুতরাং আজ সময় এসেছে আত্মজিজ্ঞাসার, সময় এসেছে চিন্তা-গবেষণা ও বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর। কারণ যারা জ্ঞান-বিমুখ, যারা আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবে না, চিন্তা-গবেষণা করে না, যারা কুপম-ুক, যারা তাদের বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে উৎসাহী নয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলেছেন :
‘এ কথা একান্তই সত্য যে, বহু-সংখ্যক জ্বিন ও মানুষ এমন আছে, যাদেরকে আমরা জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে কিন্তু তারা তার সাহায্যে চিন্তা-ভাবনা করে না; তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না; তাদের শ্রবনশক্তি আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা আসলে জন্তু-জানোয়ারের মত; বরং তার চেয়েও বেশি বিভ্রান্ত। এরা চরম গাফলতির মধ্যে নিমগ্ন।’ - [আল-আরাফ : ১৭৯]
‘হে ঈমানদার লোকেরা! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং আদেশ শোনার পর তা অমান্য করো না। তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বলে, আমরা শুনলাম; কিন্তু আসলে তারা শোনে না। নিশ্চিত জেনো, আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম পশু, বধির ও বোবা হচ্ছে সেসব মানুষ, যারা নিজেদের বিবেক ও বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না। আল্লাহর যদি জানতেন যে, তাদের মধ্যে কোন ধরনের কল্যাণ রয়েছে, তাহলে তিনি অবশ্যই তাদেরকে শোনার তওফিক দিতেন। তিনি যদি তাদেরকে শুনতে দিতেন, তবে তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতো।’ -[আনফাল : ২০-২৩]
‘এদের মধ্যে বহু লোকই তোমার কথা শোনে। কিন্তু তুমি কি বধিরদের শোনাবে তারা না বুঝতে চাইলেও? তাদের মধ্যে বহু লোক তোমাকে দেখে, কিন্তু তুমি কি সেসব অন্ধদের পথ দেখাবে, তারা দেখতে না চাইলেও? আসল কথা হল, আল্লাহ লোকদের উপর জুলুম করেন না, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করে। Ñ[ইউনুস : ৪২-৪৪]
‘তারা না কারো কথা শুনতে পারতো আর না তাদের নিজেদের বুদ্ধিতে কিছু আসতো। এরা সেই লোক, যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে আর তারা যা রচনা করেছিল, তার সব কিছুই তাদেও কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। অনিবার্যভাবে তারাই পরকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’-[হূদ : ২০-২২]
পবিত্র কোরআনই ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) ও তাঁর সাহাবীদের দাওয়াতী তৎপরতা বা গণসংযোগমূলক কাজের প্রধান হাতিয়ার। কারণ কোরআন শুধু যে সত্যের দলিল তাই নয়, কোরআন ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবীর জন্য একটি বিরাট মোজেজা। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে মহানবী (সঃ) বলেছেন, ‘এমন কোন নবী ছিলেন না যাকে কোন মোজেজা প্রদান করা হয়নি, যা দেখে লোকেরা ঈমান আনতো। কিন্তু আমার মোজেজা হলো অহী (কোরআন), যা আল্লাহ আমার প্রতি নাযিল করেছেন। সুতরাং আমি আশা করি কেয়ামতের দিন তাদের অনুসারীদের তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে।’ -[বুখারী]।
বস্তুত কোরআনের ভাষায় রয়েছে এমন এক সম্মোহনী শক্তি এবং এর বাণীতে রয়েছে মানুষের বিবেক ও চিন্তার জন্য এমন খোরাক যা কঠিন প্রাণ আরব-বেদুইনদের মনকেও বিগলিত না করে পারেনি।
হযরত ওমরের মত কঠিন ও কঠোর স্বভাবের মানুষও; যিনি আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার জন্য উদ্যত সঙ্গীন নিয়ে রওনা হয়েছিলেন, তিনিও তো বশ মেনেছিলেন মূলত আল্লাহর কালাম আল কোরআনের বাণী শুনেই। এ কারণেই আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীদের দাওয়াতী কাজের প্রধান উপকরণ ছিল আল কোরআন। কোরআন প্রচারের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহর নবী বলেছেন :
‘একটি আয়াত হলেও তা আমার পক্ষ থেকে প্রচার কর।’ -[বুখারী]
বিদায় হজ্জের ভাষণেও মহানবী আল্লাহর কালামের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন Ñ ‘আমি তোমাদের কাছে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধর তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।’
দ্বীনের দাওয়াতে কোরআনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণ কী? কারণ, আল কোরআনই দ্বীনের আসল ভিত্তি এবং দ্বীনী জ্ঞান ও হেদায়েতের মূল উৎস। হেদায়েতের পথে উম্মতের টিকে থাকাও মূলত নির্ভর করে আল কোরআনের সাথে তাদের গভীর সম্পর্কের উপর। উম্মতের রক্ষাকবচও হচ্ছে মূলত আল্লাহর কালাম আল কোরআন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের মূল সূত্রই হচ্ছে এই কোরআন। মানব জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে, কোন জাতির উত্থান-পতন নির্ভর করতো মূলত আল্লাহর কালামের সাথে তারা কী ব্যবহার করতো তার উপর।
আল্লাহর কালাম চিরদিনই ছিল মানব জাতির জন্য সৌভাগ্যের পরশ-পাথর। যে জাতি আল্লাহর কালামকে বুকে ধারণ করেছে, আল্লাহর কালামকে তাদের জীবনে সর্বোচ্চ স্থান ও সম্মান দিয়েছে, বিনিময়ে আল্লাহহও তাদেরকে পৃথিবীতে গৌরবান্বিত করেছেন, সম্মান দিয়েছেন।
আর পূববর্তী জাতি সমূহের অধঃপতনের মূল কারণই এই ছিল যে, তারা আল্লাহর কালাম থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আল্লাহর কালামের পরিবর্তে তারা নিজেদের মনগড়া ধারণা-বিশ্বাস, পীর, আলেম ও বুযুর্গ ব্যক্তিদেরকেই হেদায়েতের উৎস বানিয়েছিল। আল্লাহর কালামের পরিবর্তে নিজেদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী কিতাবধারীগণ আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত পর্যন্ত করে ফেলেছিল।
ইহুদি আলেমদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা অপবাদ দিত। অর্থাৎ নিজেদের মনগড়া কথা তারা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিত। তারা এটি করতে পারতো এজন্য যে, সমাজের মানুষের মধ্যে আল্লাহর কালামের যথার্থ কোন চর্চা ছিল না।
ধর্মীয় নেতারা নানান বাহানায় আল্লাহর কালামের চর্চার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া কাহিনী ও মতবাদ চর্চার উপরই বেশি গুরুত্ব দিতেন। আর লোকেরাও আল্লাহর কালামকে পাশকাটিয়ে ধর্মীয় নেতা, বুযুর্গ ব্যক্তিদের বয়ানের দিকেই বেশি ঝুকে পড়েছিল।
যার কারণে ইহদি আলেম সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আল্লাহর নামে আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে ও মনগড়া কথা বলা একটা রীতিতে পরিণত হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে ইহুদিদের এ বদ অভ্যাসের কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন :
‘এর পরও যারা নিজেদের মনগড়া কথা আল্লাহর উপর আরোপ করে, প্রকৃতপক্ষে তারাই জালিম।’Ñ[আলে ইমরান : ৯৪]
এ কারণেই, আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবীগণ আল কোরআনের প্রচারকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আল্লাহর রাসূল বেশিরভাগ সময়ই সরাসরি কোরআন শুনিয়েই মানুষকে দাওয়াত দিতেন। সাহাবীগণও তাই করতেন। তাঁদের মধ্যে কোরআনের চর্চা এত বেশি ছিল যে, একজনের সাথে আরেক জনের দেখা হলে তাঁরা পরস্পরকে কোরআনের কোন অংশ না শুনিয়ে কোন কথা বলতেন না।
পূর্ববর্তী কিতাবধারীরা দ্বীনকে বিকৃত করে, এর উপর নিজেদের যেসব মনগড়া ধ্যান-ধারণা আরোপ করেছে এবং পবিত্র কালামের যেসব শিক্ষাকে তারা গোপন করেছিল সেসব শিক্ষাকে প্রকাশ করে দেয়া, আল্লাহর দেয়া যেসব হালালকে তারা হারাম এবং হারামকে হালাল করেছিল সেসব বিকৃতিকে পরিশুদ্ধ করাও ছিল মহাগ্রন্থ আল কোরআনের আগমণের অন্যতম লক্ষ।
এ কারণেও কোরআনের পয়গাম মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়া ছিল মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর নবুয়তী মিশনের অন্যমত দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে আহলে কিতাবীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাক বলেছেন :
‘হে আহলি কিতাবীগণ! তোমাদের কাছে আল্লাহর রাসূল এসেছে। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে সে তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করে দেয় এবং অনেক বিষয় মাফ করে দেয়। তোমাদের কাছে একটি জ্যোতি ও সুস্পষ্ট কিতাব এসেছে। এরদ্বারা আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে নিয়ে আসেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেন। -[আল মায়েদা : ১৫-১৬]
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অতীতের বিভ্রান্ত, জালেম, ফাসেক ও অভিশপ্তদের জাতি সমূহের মত আমাদের মধ্যেও আজ আল্লাহর কালামের চর্চা ও প্রচার-প্রসার কমে গেছে এবং আমাদের দ্বীনদার লোকদের মধ্যে আল্লাহর কালামের পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া কথা ও ধারণা-বিশ্বাসকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিজেদের জীবন থেকে আল কোরআনের শিক্ষাকে বিদায় করে দিয়ে আজ আমরা অভিশপ্ত ইহদী-নাসারাদের পদাংক অনুসরণ করছি। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ-সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য সকল ক্ষেত্রেই আমরা পাশ্চাত্যের আদর্শকে অনুসরণ করে চলেছি।
পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমরা আল কোরআনের শিক্ষাকে জানার চেষ্টা না করে শুধু তেলাওয়াত করছি, আর জীবনের সর্বক্ষেত্র থেকে কোরআনের বিধানকে বিদায় করে দিয়ে পাশ্চাত্যের মর্জি মত চলছি।
পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে যেয়ে আমরা তোতা পাখির মত তাদের শিখানো বুলি আবৃত্তি করে বলছি ‘ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা।’ এই আপ্তবাক্যকে আল্লাহর নির্দেশের চেয়েও বেশি মর্যাদা দিয়ে শুধু রাজনীতি নয় সমাজ-সংস্কৃতির সর্ব পর্যায়ে আল কোরআনের প্রবেশাধিকারকে নিষিদ্ধ করতে এবং সত্য গোপন করতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ, আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আমাদের প্রচার মাধ্যম এমনকি দ্বীনের তথাকথিত মেহনতকারীরাও উঠে পড়ে লেগেছেন।
অথচ আল কোরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আল্লাহ বলেছেন :
‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) মনোনীত করলাম।-[আল মায়েদা :৩]
এই পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের অনুসরণ করার নির্দেশই দিয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন :
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হও আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ ক‘রো না; নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’-[বাকারা : ২০৮]
রাজনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মহাগ্রন্থ আল কোরআনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। নামাজ-রোজার মত আল্লাহর এসব হুকুম পালন করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর দাসত্ব ও গোলামী করাই হচ্ছে ঈমানের অনিবার্য দাবী। কিন্তু রাজনীতি সহ সমাজ-সংস্কৃতির সর্বস্তর থেকে ইসলাকে নির্বাসিত করা সত্যকে গোপন করারই নামান্তর এবং এটি ইহুদীদেরই অন্যতম বৈশিষ্ট।
নিজেদের স্বেচ্ছাচারীতাকে বজায় রাখার জন্য আল্লাহর কালামের কিছু মানা এবং কিছু না মানার কারণে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ইহুদীদের তীব্র সমালোচনা এবং করেছেন এবং এসব কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
যারা ইসলামকে খ-িত ও সংকীর্ণরূপে তুলে ধরে; স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কিংবা মূখতা বশত যারা আল কোরআনের কোন আদর্শকে, আল্লাহর নূরকে তথা সত্যকে গোপন করে তাহলে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অভিশাপ আর আখেরাতে রয়েছে কঠিন আযাব :
‘তাহলে কি তোমরা আল্লাহর কিতাবের একাংশ বিশ্বাস কর আর অপর অংশকে কর অবিশ্বাস? জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে যারাই এ ধরনের আচরণ করবে তাদের জন্য রয়েছে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান আর পরকালের জীবনে কঠিন আযাব। তোমরা যা কিছুই কর আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর নন।’ -[আল-বাকারা : ৮৫]
‘নিশ্চয়ই কিতাবের মধ্যে মানুষের হেদায়েতের জন্য যেসব বিস্তারিত পথনির্দেশ ও তথ্য আমি নাযিল করেছি সেসবকে যারা গোপন করে, সেসব লোকের প্রতিই রয়েছে আল্লাহর অভিশাপ এবং অভিশাপ বর্ষণকারীদেরও অভিশাপ।’ -[বাকারা : ১৫৯]
‘এসব আহলি কিতাবদেরকে সেসব ওয়াদাও স্মরণ করিয়ে দাও, যা আল্লাহ তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তা এই যে, তোমাদেরকে কিতাবের শিক্ষা লোকদের মধ্যে প্রচার করতে হবে, তা গোপন করতে পারবে না। কিন্তু তারা কিতাবকে পিছনে ফেলে রেখেছে এবং সামান্য মূল্যে তাকে বিক্রয় করেছে। তারা এই যা কিছু করছে তা কতই না খারাপ কাজ!’ -[আলে ইমরান : ১৮৭]
সুতরাং, আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের যে বিপর্যয়, যে জিল্লতি ও অপমান চেপে বসেছে তা কি আল্লাহর কালামের সাথে আমাদের দুর্বব্যবহার এবং সত্যকে গোপন করার পরিণাম নয়?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন