‘তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের প্রভূ বানিয়ে নিয়েছে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে কর তাদের অধিকাংশই শুনতে পায় ও বুঝতে পারে? আসলে এরা তো জন্তু-জানোয়ারের মত, বরং তার চেয়েও অধিকতর পথভ্রষ্ট।’ -[আল-ফুরকান : ৪৩-৪৪]
“...যদি কেউ একজন মানুষকে হত্যা করে- যদি তা হত্যার দায়ে বা দেশে বিশৃঙ্খলা ছড়ানোর অপরাধে না হয় -তবে সে যেন সমগ্র মানুষকে হত্যা করলো; এবং যদি কেউ একটি জীবন বাঁচায়, তবে সে যেন সমগ্র মানব জাতির জীবন রক্ষা করলো।” (আল-মায়িদা, ৫:৩২)
আল্লাহ মানুষকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন তা আর কোন সৃষ্টিকে দেননি। তিনি মানুষকে দিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধির মর্যাদা। পৃথিবীর সব সৃষ্টিকে তিনি মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। তাঁর নির্দেশেই চাঁদ-সূর্য প্রতিদিন একটি সময়ে উদয় হয় ও অস্ত যায় এবং দিন ও রাতের আবর্তন হয়। ফলে আমরা কাজ করার জন্য পাই একটি সুন্দর আলোকিত দিন এবং বিশ্রামের জন্য পাই চমৎকার স্নিগ্ধ রাত। তিনি আমাদের দেহকাঠামো এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে আমরা সব সময় মাথা উঁচু করে চলাফেরা করতে পারি। তিনি আমাদেরকে এমন বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানার্জনের সক্ষমতা ও প্রজ্ঞা দিয়েছেন যে, আমরা অন্যান্য শক্তিমান প্রাণীকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারি এবং আল্লাহ’র সৃষ্টিকে ব্যবহার করে নিজেদের জীবনমানকে উন্নত করতে পারি। সৃষ্টিজগতের সকল প্রাণীকে আল্লাহ উলঙ্গ রেখেছেন কিন্তু মানুষকে পোশাক পরার আকল ও জ্ঞান দিয়েছেন। এ সবই মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করার জন্য। আল্লাহ বলেন- “আমি আদাম সন্তানকে সম্মানিত করেছি, তাদের জন্য জলে স্থলে যানবাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে পবিত্র রিযক দিয়েছি আর আমি তাদেরকে আমার অধিকাংশ সৃষ্টির উপর মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (আল-ইসরা’, ১৭:৭০)
আল্লাহ মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট রূপ-সৌন্দর্য, কথা বলার ক্ষমতা, উৎকৃষ্ট খাদ্য, পানীয়, বাহন ও বাসস্থান দিয়েছেন যা মানুষের বিশিষ্টতাকে নির্দেশ করে।
এসবই মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত দয়ার কয়েকটি দৃশ্যমান নিদর্শন মাত্র। কিন্তু মানব প্রকৃতির মধ্যে আরও এমন কিছু রয়েছে, যা আরও বেশি গুরুত্ববহ ও মূল্যবান। তার মধ্যে একটি হল বিবেক বা ন্যায়-অন্যায় বোধ। এ বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি মানুষের প্রকৃতিতে সহজাত। যেমন সূরা আশ্ শামস্-এ বলা হয়েছে : ‘কসম মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির) এবং কসম সেই সত্তার যিনি তাকে সঠিকভাবে গঠন করেছেন, তারপর তার উপর পাপ ও নৈতিক বোধ ইলহাম করেছেন।’ [সূরা আশ শামস : ৭-৮]
বিবেক বা সুপ্রবৃত্তি সব সময়ই মানুষের সৎ বৃত্তির বিকাশ কামনা করে, মানুষকে সৎ পথে চালিত করে। মহানবী (সা.) বলেছেন- “যে কাজে তোমার মন স্থিতি লাভ করে এবং যে কাজে হৃদয় বা বিবেক স্বস্তি ও নিশ্চয়তা পায় তাই পুণ্য বা সুনীতি। পক্ষান্তরে যে কাজে তোমার মন স্থিরতা পায় না এবং বিবেক স্বস্তি পায় না তাই পাপ বা দুর্নীতি।”
আল কুরআনে মানুষের নফসের (প্রবৃত্তির) তিনটি রূপের কথা বলা হয়েছে। একটি নফস হল যা মানুষকে সব ধরনের অন্যায় ও দুষ্কৃতির কাজে উস্কানি দেয়। একে বলা হয় ‘নফসে আম্মারা’। দ্বিতীয় ধরনের নফস হল যা ভুল বা অন্যায় কাজ করলে, অন্যায় ও ভুল কথা চিন্তা করলে বা খারাপ নিয়ত বা মন-মানসিকতা পোষণ করলে মানুষকে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করে, ভিতর থেকে মানুষকে তিরষ্কার করে। এর নাম হল ‘নফসে লাউয়ামা’। আমরা একে ‘বিবেক’ও বলতে পারি। তৃতীয় হল সে নফস, যা সত্য-সঠিক পথে চলা ও ভুল বা অন্যায় পথ পরিহার করার দরুন অন্তরে স্বস্তি ও নিশ্চিন্ততা অনুভব করে। এর নাম হলো ‘নফসে মুতমায়িন্না’।
মানুষের প্রবৃত্তিতে ‘নফসে লাউয়ামা’ও ‘নফসে মুতমায়িন্না’ মানুষের রূহ বা ক্বলব ও আধ্যাত্মিকবোধকে শক্তিশালী করে। অন্যদিকে ‘নফসে আম্মারা’ জৈববৃত্তি মানুষকে বস্তুজগতের প্রতি আকৃষ্ট করে। এ আকর্ষণ না থাকলে মানুষ জীবনবিমুখ বা বৈরাগ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে, যা আল্লাহ’র পছন্দ নয়। মানুষ যেহেতু পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি তাই তাকে জীবনবিমুখ হলে চলবে না, বরং পার্থিব জগতকে আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। সুতরাং পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উভয় দিকে ভারসাম্য রক্ষা করেই মানুষকে চলতে হবে। কারণ এখানেই মানুষের পরীক্ষা। এ পরীক্ষা থেকে কেউ মুক্ত নয়। পবিত্র কুরআনে হযরত ইউসুফ (আ.) দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তাঁকেও এ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁর বরাত দিয়ে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে-’(ইউসুফ বলল) আমিও নফসের থেকে মুক্ত নই। নিশ্চই নফস মন্দ কাজের আদেশ দেয়। তবে আমার রব যার প্রতি অনুগ্রহ করেন তাকে ছাড়া।’ (সুরা ইউসুফ : ৫৩)।
মানুষ যখন ‘নফসে আম্মারা’ বা কুপ্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে তখন তার বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। তখন সে এমন সব জঘন্য কাজও করে ফেলে যা এমনকি ইতর প্রাণীরাও করে না। এ অবস্থারই ইঙ্গিত সূরা ফুরকানে করা হয়েছে যার উল্লেখ আমরা শুরুতেই করেছি। এ অবস্থায় সে চোখ থাকতেও অন্ধ ও কান থাকতেও বধিরের মত কাজ করে। এ ধরনের বিবেকহীন লোকদেরকে আল্লাহ হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করেন। সূরা কাছাছে আল্লাহ বলেন- “তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত হেদায়াতের পরিবর্তে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।”- [আল-কাছাছ : ৫০]
তিরমিজি, সুনানে আহমদ ও ইবনে মাজায়ে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, ‘মুমিন গোনাহে লিপ্ত হলে তার কলবে একটি কালো দাগ পড়ে। তারপর যদি সে তওবা করে, পাপকাজ ছেড়ে দেয় এবং ক্ষমা চায়, তবে তার কলব পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে আবার গোনাহে জড়িত হলে কালো দাগ বেড়ে যায়। অবশেষে এই দাগ তার অন্তরকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়।’
মানুষের নৈতিকতা, বিবেক বা চরিত্রেরই অপর নাম হল মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব বা বিবেকবোধের কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা বা আশরাফুল মাখলুকাত। মনুষ্যত্ব হারিয়ে গেলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না বরং তার চেয়েও নীচে নেমে যায়।
প্রশ্ন হল- সৃষ্টির সেরা মানুষ কেন, কখন ও কীভাবে বিবেকহীন হয়? এ প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সূরা আত্ তীনে এভাবে দিয়েছেন :
“নিশ্চয়ই আমি মানুষকে উৎকৃষ্ট ছাঁচে সৃষ্টি করেছি। তারপর তাকে আবার ইতরের চেয়েও ইতর অবস্থানে ফিরিয়ে দেই। অবশ্য তাদেরকে না, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে। তাদের জন্য আছে অফুরন্ত প্রতিদান।” (আট-তীন: ৪-৬)
সূরা আস শামসেও আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সুস্পষ্ট হেদায়াত দিয়ে বলেছেন-
‘কসম মানুষের নাফ্সের আর তাঁর যিনি তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছেন। অতঃপর তিনি তাকে অবহিত করেছেন তার পাপসমূহ ও তার তাকওয়া সম্পর্কে। নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে। এবং সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা (নাফস)-কে কলুষিত করেছে।’ আস শামস: (৭-৯)
বস্তুত, মানুষ যখন নিজেকে বল্গাহীন স্বাধীন মনে করে; যখন সে মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক আল্লাহকে ভুলে যায়, তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় এবং আখেরাতে আল্লাহ’র কাছে জবাবদিহিতার বিষয়কে অবিশ্বাস করে, তখনই সেচ্ছাচার হয়ে পড়ে। আর এ স্বেচ্ছাচারি হতে গিয়ে সে মূলত কুপ্রবৃত্তির দাস হয়ে পড়ে। তখন তার কাছে ভোগবাদকে জীবনের সফলতার একমাত্র মানদণ্ড বলে মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত এ বস্তুবাদি বা ভোগবাদি ভুল জীবন দর্শন মানুষের সব সর্বনাশের মূল। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এ ভুল বিশ্বাস বা ভুল মূল্যবোধই মানুষকে সীমাহীন লোভ, লালসা ও পাপাচারের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে পৃথিবীতে বড় বড় জালিম স্বৈরাচার তৈরি হয় এবং মানুষ মানুষের দাসে পরিণত হয়।
সুতরাং, মানুষের জন্য আল্লাহ’র সবচেয়ে মূল্যবান দয়া হল ঈমান তথা জীবনের সফলতার প্রকৃত মূল্যবোধ, যা মানুষকে বিশেষভাবে জানানো হয়েছে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ‘ওহী’ বা ঐশী প্রত্যাদেশ প্রেরণ করে; যার উপর নির্ভর করে মানুষের মনুষ্যত্ব; যে মনুষ্যত্ব হারালে মানুষ আর মানুষ থাকে না, মানুষরূপী পশুতে পরিণত হয়।
বস্তুবাদী দর্শন মানুষকে শুধুমাত্র জৈববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমষ্টি মনে করলেও ইসলাম তা মনে করে না। শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির কারণেই মানুষ ইতরতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। বরং বুদ্ধির জোরে মানুষ এমন উন্মত্ত ও পাশবিক আচরণও করতে পারে যা কোন ইতর প্রাণীর পক্ষেও সম্ভব হয় না।
ইসলাম মানুষের মনুষ্যত্ব বা বিবেকের পূর্ণ বিকাশ চায়। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি আবির্ভূত হয়েছি।’
“হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই একজন মুমিন ব্যক্তি তার উত্তম চরিত্রগুণে সেসব আবেদ লোকের মর্যাদা লাভ করতে পারে, যারা সারা রাত নামাযে কাটায় আর সারা বছরই রোযা রাখে।” -[আবু দাউদ]
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সবচেয়ে উত্তম, যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।” -[বুখারী, মুসলিম]
Muhammad Abul Hussain
বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫
পশু প্রবৃত্তি থেকে মুক্তি প্রয়োজন
যখন পৃথিবী চলে যায় দানবের কব্জায়
যখন পৃথিবী চলে যায় দানবের কব্জায়
তখন আইন আর আইন থাকে না
সত্যগুলো আর থাকে না সত্য
জাতিসংঘ কি থাকতে পারে জাতিসংঘের মত?
যখন পৃথিবী চলে যায় দানবের কব্জায়
তখন শয়তানির আর থাকে না আড়াল
ভণ্ডামির মুখোশগুলো খসে পড়ে যায়
বিবেকহীন মানুষগুলো হয় একচোখা দাজ্জাল
সভ্যতা-ভব্যতা তখন শরমে পালায়।
যখন পৃথিবী চলে যায় দানবের কব্জায় -
পৃথিবীতে শুরু হয় দানব নৃত্য
সভ্যতার যাদুঘর লুণ্ঠিত হয়, কম্পিত হয় চিত্ত
দানবের তাণ্ডবে লুটায় সত্যের মিনার।
যখন পৃথিবী চলে যায় দানবের কব্জায়
তখন আর কোন সাড়া-শব্দ থাকে না
বিবেকও বোবা হয়ে যায়
উদ্বাহু নৃত্য করে পাশব দানব
আতঙ্কে নীল হয়ে নিখিল মানব।
যখন পৃথিবী চলে যায় দানবের কব্জায়
সময় থমকে দাঁড়ায় মানবতা গুমরে মরে
পৃথিবী বদ্ধভূমি হয়ে যায়
হাত-বাধা মানবতা অসহায় কাতরায়
পৃথিবী চলে যায় আদিম গুহায়
দানবতা থাকে শুধু মানবতা পালায়।
বুধবার, ৭ মে, ২০২৫
আমার কানে লুকিয়ে থাকা যা যা তুমি পাবে
মুসাব আবু ত্বহা
এক.
যখন তুমি আমার কান খুলে নেবে, তখন আলতো করে স্পর্শ ক'রো;
কেননা, আমার মায়ের কণ্ঠস্বরের স্পন্দন এর ভেতরে কোথাও থেকে যাবে।
যখন আমি আত্মভোলা থাকি, তার কণ্ঠস্বরেই আমি সম্বিত ফিরে পাই।
তুমি হয়তো অপ্রত্যাশিতভাবে আরবি ভাষায় গান, ইংরেজি কবিতা;
যা আমি নিজে আবৃত্তি করি, অথবা আমাদের উঠোনে পাখিদের
কিচিরমিচির করে গাওয়া গানের সম্মুখীন হতে পারো।
যখন তুমি কাটা কান সেলাই করবে, তখন এগুলো আবার
যথাস্থানে তুলে রাখতে ভুলো না, সেগুলো আবার সাজিয়ে রেখো,
যেমন তুমি তোমার শেলফের বইগুলোর সাথে করো।
সূত্র: Things You May Find Hidden in My Ear Mosab Abu Toha
শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৫
আপনা মাংসে হরিনা বৈরী
সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঈমান ও আমলের সম্পর্ক
ঈমান অর্থ বোধ, বিশ্বাস, স্বীকৃতি দেওয়া, আস্থা স্থাপন করা। আর আমল অর্থ কাজ। ঈমান ও আমল বা বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রত্যেক মানুষের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তার মন, তার বোধ ও বিশ্বাস, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তার ধারণা। মানুষ যে কাজই করুক না কেন; সে কাজ করার আগে তার মনে কাজটির প্রতি একটি আকাক্সক্ষা বা ইচ্ছা তৈরি হয় এবং ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন সে কাজটি করার পক্ষে একটি মত বা যুক্তি খুঁজে পায় বা কাজটি সম্পাদন করাকে সে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এভাবে সচেতনভাবে হোক কিংবা অবচেতন মনে-মানুষের বোধ ও বিশ্বাস তার কাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। সুতরাং বলা যায়, মানুষের কাজ মূলত তার বিশ্বাসের প্রতিফলন।
ঈমান ও আমলের ব্যাপারটিও এরকম। একজন প্রকৃত মুমিনের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তার ঈমান। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মুমিন (বিশ্বাসী) ও কাফের (অবিশ্বাসী) ব্যক্তির ধারণা, বিশ্বাস ও জীবনবোধ যেমন এক নয়, তেমনি তাদের কাজও একরকম হতে পারে না। যারা পরকাল, আখেরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা, জান্নাত-জাহান্নাম বিশ্বাস করেন তাদের জীবনধারা বা জীবনপদ্ধতি কখনও তাদের মত হবে না যারা এসবে বিশ্বাস করেন না, যারা মনে করেন দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন, মৃত্যুর পর আর কোন কিছু নেই, পরকালে আল্লাহ’র কাছে জবাবদিহিতা বলে কিছু নেই। এ বিষয়টি স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন একাধিকবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন - “জাহান্নামগামী লোকেরা ও জান্নাতগামী লোকেরা একরকম নয়। জান্নাতগামী লোকেরাই সফলকাম।” (আল হাশর: ২৫) “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসরণ করে, সে কি আল্লাহর আক্রোশে পতিত লোকের ন্যায় হতে পারে?!” (৩: ১৬২)
মদীনায় আবদু’ল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিগণ রাসূলুল্লাহ’র (স.) সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি তাদেরকে বলেন, তোমরা কি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থ জানো?” তারা বললো, “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।” রাসূলুল্লাহ (স.) বললেন, “(এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে) আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ (ইবাদত বা দাসত্ব পাওয়ার যোগ্য) নেই, আর মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসূল-এ কথার সাক্ষ্য দেয়া, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা এবং রমযানে রোযা রাখা।” -মিশকাত
আবূ হুরাইরাহ আব্দুর রহমান ইবনু সাখর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ’’নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তোমাদের চেহারা এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল।’’ সুতরাং শুধু মুখে মুখে ঈমানের দাবি করাই যথেষ্ট নয়; বরং আন্তরিক বিশ্বাস ও আমল তথা কথা ও কাজের মিল থাকাও জরুরি। অনেকে বলেন, ভাই নামাজ না পড়লে কী হবে, আমার ঈমান ঠিক আছে; তাদের জানা উচিত আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন পবিত্র কুরআনের যত জায়গায় ঈমানের কথা বলেছেন তার প্রায় সব জায়গাতেই তিনি আমলের কথাও বলেছেন। এ থেকেই বুঝা যায় ঈমানের সাথে আমলের সম্পর্ক কত গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর ক্ষমা, মার্জনা ও দয়ার প্রশস্ততার ওপর নির্ভর করে নাজাত পাবে বলে নিজে নিজেই ধারণা করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে আর প্রবৃত্তির দাসত্ব এবং কামনার পেছনে ছুটছে। আল কুরআনে তাদের কাজকে বোকামি ও দুর্বলতা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- “তাদের মাঝে এমন কিছু মূর্খ লোক আছে, যাদের মিথ্যা আকাক্সক্ষা ছাড়া কিতাবের কোন জ্ঞানই নেই। তারা কেবল অলীক ধারণা পোষণ করে থাকে।” (২:৭৮) বস্তুত, মানুষ যখন আল্লাহর কালামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায় তখন মনগড়া ধারণা কল্পনাকেই তার পথ প্রদর্শক বানিয় নেয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে, সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কুপ্রবৃত্তির গোলাম বানায় অথচ আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা করে, সেই নির্বোধ ও ব্যর্থ।” -তিরমিযী
আনাস (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স.) আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দানকালে বলেছেন, ‘যার মাঝে আমানাতদারী নেই তার মাঝে ঈমান নেই। আর যার মাঝে ওয়াদা পালন নেই তার মাঝে দীন নেই।’ -মিশকাত
আমর বিন আবাসা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স.)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ঈমান কি?” জবাবে তিনি বললেন, “সবর (ধৈর্য ও সহনশীলতা) এবং ছামাহাত (দানশীলতা, নমনীয়তা ও উদারতা) হচ্ছে ঈমান।”-মুসলিম নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহ’র রাসূল বলেছেন- “যে নামাজ ত্যাগ করবে, সে নিশ্চিতভাবেই কাফের হয়ে যাবে।” (সুনান তিরমিজি, ২৬২১)
সুতরাং ঈমানের ঘোষণা দেয়ার পর আল্লাহ’র অবাধ্য হওয়া বা স্বেচ্ছাচারিতার কোন সুযোগ নেই। বরং পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ’র ইচ্ছার নিকট নিজেকে সোপর্দ করে ইসলামে দাখিল হওয়াই হচ্ছে ঈমানের দাবি। আল্লাহ বলেন- “হে মুমিনগণ, তোমরা পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না । নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু।” (বাকারা: ২০৮)
মহানবী (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে, আল্লাহর জন্য কারো প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। আল্লাহর জন্যেই কাউকে দান করে এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকে; সে ব্যক্তি তার ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিলো।”-বুখারী
বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪
কবি মোশাররফ হোসেন খান'র দাহন বেলায়: কালের ক্রন্দন ও দ্রোহের কবিতা
কবিতা সময়কে ধারণ করে। কেননা কালের বিরূপতা কবিমনকেও ব্যথিত করে। কবিরাও মানুষ। তাদেরও মন আছে, ভালোবাসা-ঘৃণা, ব্যাথা-বেদনার অনুভূতি আছে। বরং বোধকরি তাদের মন একটু বেশিই সংবেদনশীল। তাই কালের ক্রুরতা, ঢ়ূরতা, নিষ্ঠুতা, ক্রন্দন ও দ্রোহ কবি ও কবিতাকে স্পর্শ করে, নাড়া দেয়। তবে কবি যেহেতু শিল্পী, তার শিল্পকুশলতায় কালের কবিতাও কালোত্তীর্ণ হতে পারে।
মোশাররফ হোসেন খানের ‘দাহন বেলায়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। তার মানে - গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো লেখা হয় আজ থেকে বাইশ বছর আগে। কিন্ত সে সময়ে ‘বারুদের গন্ধে জেগে ওঠা লাশের যৌবন’ পঙক্তিটি আমাকে যেভাবে শিহরিত করেছিল, এখন তো বোধ হয় আরও বেশি শিহরিত ও উদ্দীপ্ত করে। আমার কাছে তো মনে হয়েছে কবিতাগুলো এই চব্বিশের গণ-আন্দোলনের তরুণদের রক্তে বারুদ জ্বালানোর জন্যই লেখা হয়েছে। অবশ্য, মোশাররফ হোসেন খান আশির দশকের তরুণ কবি হলেও তার কবিতা থেকে তারুণ্যের দীপ্তি একটুও কমেনি। চব্বিশের ছাত্র-জনতা গণ আন্দোলনকে গণ- অভ্যুত্থানে রূপ দিতে তিনি অত্যন্ত সাহসের সাথে রণবাদ্য বাজিয়ে কবিতা লিখেছেন।
দাহন বেলায় কাব্যগ্রন্থে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, অবরুদ্ধ প্রাণচাঞ্চল্য ও কালের বিরূপতা হাহাকার করে ওঠে, যখন কবি বলেন-
'প্রতিদিনের বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলিও এখন বিপরীতার্থক।
দেশকে এখন মনে হচ্ছে মৃত্যু-গহবর
আর মানুষগুলিকে বিষধর অজগর।'
(নখের বিস্তার)
কিংবা-
‘বুনো বাতাসের চোখে ভয়াবহ ক্রোধ:
সমুদ্র প্রহরগুলো বেয়াড়া তার্কিক
কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বুকে অসুখী ময়ুর’
(দাহন বেলায়)
তখন মনে হয়, এই কবিতা তো সদ্য লেখা হয়েছে।
চব্বিশের গণ-আন্দোলন যে প্রেক্ষাপটে দানা বাঁধে, দাহনবেলায়'র কিছু কবিতা প্রায় একই প্রেক্ষাপটে লেখা হয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলনের পর মানুষ এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু হলেও স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশি দেরি লাগেনি। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন ছিল সেটি। যদিও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সংবিধানের অংশ ছিল না, কিন্তু সবগুলো রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে সেটি করা হয়েছিল।... ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। সে সময় নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে শেখ হাসিনা যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে তার সেই আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে।' '১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোট দেবার জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়। সাড়ে ছয় কোটি ভোটারের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়ে। নির্বাচনে কোথাও কোন ধরণের সহিংসতা দেখা যায়নি।’
এই নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। তবে নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় কোন দল সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।'
এই নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ৮৪টি আসনে। এছাড়া জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে।'
কিন্তু এই নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী শক্তির বিজয় আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তাদের দোসর ফ্যাসিবাদী শক্তি মেনে নিতে পারেনি। তাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির সহজ পথ ত্যাগ করে তারা দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। আধিপত্যবাদী শক্তির মোকাবেলায় দেশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যেখানে বাকশালের একদলীয় দুঃশাসন থেকে জাতিকে মুক্তি দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে গিয়েছিলেন, সেই অবস্থান থেকে জাতিকে বিচ্যূত করতে ফ্যাসিবাদী শক্তি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের ধুম্রজাল তৈরি করে নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার কুটকৌশল শুরু করে। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্ব গঠিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তারা দেশের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে, জনরায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্র ও আদালতের বিপরীতে গণ-আদালতের নামে বুনো আদালত প্রতিষ্ঠিত করে দেশের মধ্যে এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদৌলতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে সেই ব্যবস্থাটিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে গড়িমসি শুরু করে বিএনপি সরকার। যার পরিণতিতে ফ্যাসিবাদ ও আগ্রাসন বিরোধী জনমতের বিভক্তির সুযোগ নিয়ে ২১ বছর পর আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায় আধিপত্যবাদী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট ফ্যাসিবাদ। ক্ষমতায় আসার পর তাদের এই প্রতিহিংসা আরও বেশি দানা বেঁধে ওঠে। সেই সময়ের ক্ষুধা, দারিদ্র, বিভেদ-বৈষম্য, স্বপ্নহীন হতাশা, পশ্চাৎপদ ও বোধহীন চৈতন্যের দাহন চিত্র দাহন বেলার কবিতাগুলোতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যখন কবি তার প্রিয়তমাকে বলেন-
“তাকে বলি: একুশ বছর পর হাঙ্গরের দল
আবার উঠেছে জেগে। খরা-বানে ভেঙেছে কপাল।
নদীর উৎসমুখ যতই করুক তোলপাড় -
নাভীর ওপরে এখনতো কেবল পেটের ক্ষুধা।
নাভীর ওপরে কামহীন ক্ষুধা বিশুদ্ধ আগুন।
যে আগুনে ভস্ম হয় শতশত দেশ-মহাদেশ!
তোমার দাবির চেয়ে বেশি দাবি সুষম খাবার,
ভাতের গন্ধের চেয়ে দামী নয় দেহের সাঁতার।
হাঙ্গরের মুখে রেখে বারকোটি ক্ষুধার্ত মানব
স্নানে যাবো না, কসম! ছোঁবনাকো তোমার পশম ॥’
(হাঙ্গর, ২৩.৬.১৯৯৬)
“চারদিকে ধ্বংস ক্ষয় মৃত্যুর কোরাস।
শূন্য ভাতের পাতিল, ধূসর কলস-
নাগিনী নি:শ্বাসে গেয়ে যায় অবিরাম।
এই যাতনার গান, বিষাক্ত অনল
দিনান্তের দীর্ঘশ্বাস, অমল-ধবল-
কেবল কবির জন্য এ ব্যথার ভার।”
(দিনান্তের দীর্ঘশ্বাস)
এখানে দুঃখ-বেদনার পাশাপাশি দ্রোহের আগুনের উত্তাপও অনুভব করা যায়।
এ সময় একটি তোষামোদি শ্রেণি গড়ে ওঠে, যারা তোষামোদি ব্যবসায় রাতারাতি আকাশ ছুঁয়েছে; যার একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় ‘গন্তব্যের দিকে’ কবিতায়-
“সবাই যখন তোষামোদী ব্যবসায় রাতারাতি আকাশ ছুঁয়েছে
পকেটে ভরেছে সুবিধার মুদ্রা
কিংবা পেয়ে গেছে ঝলমলে তপ্ত আসন,
ঠিক তখনও কতটা অবৈষয়িক আমি
দিব্যি মালকোশ বাজিয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছি
শব্দের মতো এক অদরকারি তৈজস!”
এখানে চাটুকারদের বিপরীত অবস্থানে থাকা মানুষের দুঃখ বেদনা ও হতাশার সুরও উঠে এসেছে। এই কবিতাশ হতাশার সুর আরও স্পষ্ট হয় যখন কবি বলে ওঠেন-
“কেন যে এমনি একটি সুবিধাবাদী মূর্খদের
সঙ্গীত শুনিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবার দায়ভার সেধে কাঁধে তুলে নিলাম!
যাদের হৃদয় বলতে কিছু নেই, যাদের বসবাস মানবতার
ঠিক উল্টো পিঠে!
এ সময় বিভাজনের রাজনীতির খপ্পরে পড়ে সমাজ মানস দুষিত হয়, বাড়তে থাকে হিংসা বিদ্বেষ-
“সবাই জানে-এক ফুলকি দ্রোহ, এক ফালি দুর্বিনীত
সাহসের ঢেউ এবং একগুচ্ছ অমেয় প্রত্যয় ছাড়া
পার্থিব সম্পদ বলতে আমার আর কিছুই নেই।
তবু কেন চারপাশে জ্বলে ওঠে দাউ দাউ ঈর্ষার আগুন?”০
(বনমানুষের ডেরায়)
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দাহন বেলায় সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ, ধ্বংস, নিষ্ঠুরতার ফলে নিপীড়িত মানুষের হাহাকারের শোক ও বিষাদ সঙ্গীতও শুনতে পাই যা কালের ক্রন্দন হয়ে এখনও সমানভাবে আমাদের হৃদয়কে ব্যথীত করে-
‘পৃথিবী উপচে পড়ে বিষণ্ণতা, শকুনের ডাক
চোখের ওপরে মেঘ, মাথার উপর কালো কাক
দূর থেকে ভেসে আসে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর সঙ্গীত
জনপদ লোকালয়ে ছেয়ে যায় শোকের ইঙ্গিত।’
(পাতালের গুহা থেকে)
“ঝড়ের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছো বারবার তবুও দাঁড়িয়ে আছো। সম্মুখে চলেছো দুর্নিবার!
বিষাক্ত ছোবলে কতবার আক্রান্ত হয়েছো তুমি,
তবুও ছাড়নি এতটুকু তোমার নিজস্ব ভূমি!
কত না হয়েছে পাশাখেলা, কত না ফানুস ছল,
কত যে উঠেছে ফুসে নরপশু, হায়েনার দল। কতভাবে হয়েছো ঝাঁঝরা, তবু স্থির আছো তুমি,
তবুও ছাড়নি এতটুকু তোমার প্রাণের ভূমি।
এখানে ঝরেছে কত প্রাণ- হিসাব রাখেনি কেউ, আছড়ে পড়েছে রক্ত বন্যা- ঝিলাম নদীর ঢেউ! শহীদের খুন মেখে সবুজ হয়েছে গাঢ় লাল, কাফনের পতাকায় লিখে গেছো নাম- চিরকাল।
(অবাক কাশ্মীর)
“পৃথিবী চলেছে মৌসুমী বায়ুর পিঠে।
এখন শ্রাবণ।
মেঘগুলো যাযাবর বেদের বহর।
গুণটানা মাঝির মতো আমরা ক্লান্ত যখন, যখন ঘরে ফিরছি প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে, গুজরাট তখন ফুঁপিয়ে উঠছে প্রচণ্ড পিপাসায়।
রক্তবৃষ্টি ছাড়া সেখানে আসে না শ্রাবণ!
(গুজরাট এবং রক্তাক্ত শ্রাবণ)
“উপমাহীন এক বিধ্বস্ত ভূখণ্ডের নাম- কসোেভা!
বলকানের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে লুহাওয়া প্রিস্টিনা এখন লাশের নগরী পাহাড়ী ঝরনার মত গড়িয়ে পড়ছে কেবল রক্তবৃষ্টি।
কসোভার জীবন এখন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর!
কসোভা মানেই যেন সার্বিয় হায়েনার হিংসার দাবানল!
কসোভা মানেই আমার সূর্যের সমান দীর্ঘশ্বাস!”
(কসোভা ‘৯১)
এই শোক, এই মৃত্যুর সঙ্গীত এই ধ্বংস যেন আজ আমাদের নিত্য নিয়তি হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনে প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষের উপর চালানো হচ্চে পৈশাচিক গণহত্যা। আমরা যেন এতে অনেকটা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি। কিন্তু কবির মন তা কখনো মানতে পারে না। তিনি বলে ওঠেন-
'আমার এ চোখ দেখতে অপারগ মানুষের ধ্বংসাবশেষ
অথচ প্রতিদিনই দেখতে হচ্ছে বিভৎস কংকাল'
ঘুমুতে যাবার আগে প্রার্থনায় নত হই:
প্রভু, তোমার অলৌকিক ফুৎকারে
এই পৃথিবী বাসযোগ্য করে দাও।
কাল প্রভাতেই যেন দেখতে পাই মানুষের উত্থান
(সবুজ উত্থান)
দাহন বেলায় হতাশা, হাহাকার, স্বপ্নভঙ্গের বেদনার পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়াবার আহবান, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, দ্রোহ অনিবার্য শব্দ ও পঙ্ক্তির দ্যোতনায় এমনভাবে উঠে এসেছে যা যুগ-যুগান্তর ও লোক লোকান্তরে হৃদয়-মনকে দোলা দিয়ে যায়।
যেমন, 'পাতালের গুহা থেকে' যখন কবি বলেন-
‘মানুষ তরঙ্গ হও, মুছে ফেলো শোকের ললাট
মানুষ সমুদ্র হও, ভেঙ্গে চলো কালের কপাটl’
তখন দুর্বিনীত সাহসে জেগে ওঠে তারুণ্য। এ কবিতার প্রতিটি পংক্তি অনবদ্ধ শব্দ ও ছন্দের গাঁথুনিতে দ্যোতনা ছড়ায়। যেমন:
‘শাণিত প্রহর ভেঙ্গে তবু এসো দীপ্রমহাকাল
রক্তের তরঙ্গ ফুঁড়ে জেগে ওঠো সমুদ্র উত্তাল।
পাহাড় টপকে এসো দুর্বিনীত সাহসের ঘোড়া
জেগে ওঠো জনপদ-লোকালয়, পর্বতের চূড়া।’
থাকনা শোকের নদী, আসমুদ্র হৃদয়ের জ্বালা
তবুও ক্রন্দন নয়। শুরু হোক হিসাবের পালা।
পাতালের গুহা থেকে জেগে ওঠো সাহসের ঘোড়া
জেগে ওঠো জনপদ-হিমালয়, পর্বতের চূড়া।
প্রতিটি কবিতায় হাহাকারের পরই শক্তি সঞ্চয়, স্বপ্নের অঙ্গীকার দেখা যায়। যেমন সবুজ উদ্যান কবিতায় কবি বলেন-
‘মানব জন্মের এই এক করুণ পরিণতি
জানি না, কতোকাল আর দেখে যেতে হবে দুঃসহ রক্তনদী
আমার এ চোখ দেখতে অপরাগ মানুষের ধ্বংসাবশেষ
অথচ প্রতিদিনই দেখতে হচ্ছে বীভৎস কংকাল
তবুও আমি অপেক্ষায় আছি
আমিতো দেখে যেতে চাই-
উৎসবমুখর পৃথিবী
আর মানুষের সবুজ উত্থান।
দাহন বেলায় কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যে একটি সময়ের অবয়ব ও তার দাহন যন্ত্রণার চিত্রকল্প উঠে আসে। তবে মনে হয় সেই সময়টা এবং তার দাহন যন্ত্রণা যেন চলমান। এই দাহন বেলায় তাই অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক টানাপোড়নের ছায়াপাত রয়েছে।
যেমন:
শিয়রে শকুন ওড়ে, ধূসর খামার!
এ ভূমি সেনের নয় - তোমার আমার।
(এ ভূমি সেনের নয়)
রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রভাব একটি জনপদে কী প্রভাব ফেলে তা এ কবিতাটিতে অপূর্ব শিল্প সুষমায় ফুটে উঠেছে-
এ নয় চোখের দেখা- দেখার অধিক।
পাতার মর্মর ধ্বনি, মৃত্যুর নূপুর
ক্ষুধার ক্রন্দন আর দহন-দুপুর-
এ নয় জীবন খেলা- বীজের অলীক।
চোখের ভিতরে বিষ-বিষাদের ছায়া।
কখন যে খসে গেছে তালুকের তাজ,
সবুজ মথিত করে উড়ে গেছে বাজ-
মথিত করেছে আর মাতৃত্বের মায়া।
রক্তে ভেজা মেজরাফ- মূর্ছনায় নীল!
উধাও সঙ্গীত-সুর, বেড়েছে রোদন-
ঘাতক কেড়েছে সুখ-সুখের বোধন,
পৃথিবীর মুখে দেখ কালিমার তিল।
দাহন যন্ত্রণা থাকলেও কবিদের কাজ কিন্তু স্বপ্ন দেখানো। কবি মোশাররফ হোসেন খান তাই শত প্রতিকূলতা ও হতাশার মধ্যেও সাহস ও স্বপ্নের কথা অনিবার্য শব্দের গাঁথুনিতে তুলে ধরেছেন।
শত ঝঞ্ঝা, শত বাধা- পথ চলে যায় বহু দূর-
তবুও আরেক প্রান্তে দেখি মুখরিত পরিবেশ
কান পেতে শুনি- কার যেন বেহালার সুর-
বিপুল বিস্ময়ে বাজে; জেগে ওঠে সবুজ স্বদেশ।
এভাবেই কাটে দিন, অগণন তারাহীন রাত,
অমাবস্যা শেষে হাসে ঝলমলে পূর্ণিমার চাঁদ ॥
‘দাহন বেলায়’ কবিতায় জলহীন দাহন বেলায় বোধহীন তারুণ্য যেন চৈতন্যহীন লাশ। এ অবস্থায় হিরন্ময় ইস্পাতের আকাঙ্ক্ষায় থাকেন কবি। তিনি অপেক্ষায় আছেন কোন এক অবাধ্য বালকের। কেননা তার হাতে আছে বোধের বারুদ।
“কোথায় লুকিয়ে আছে হিরন্ময় ইস্পাত
উপত্যকার শিখর থেকে উড়ে যায় অবাধ্য বালক
বালক ছড়িয়ে যায় দু'হাতে বারুদ
বারুদের গন্ধে জেগে ওঠে লাশের যৌবন
যখন যৌবন জাগে- দাহ্যের পশমে উল্কি আঁকে সুঁচের নখর হ্রদের অতল থেকে উঠে আসে বজ্রের কোরাস থেমে যায় দাবদাহ, দাঁতালো প্রবাহ
যখন যৌবন জাগে-
তখন আশ্চর্য অন্ধকার ফুঁড়ে
পৃথিবীর উঠোন পেরিয়ে
কবরের পর কবর মাড়িয়ে ছুটে চলে নক্ষত্রের ব্যাধ
ছুটে চলে-
বৈশাখী ঘোড়ার পিঠে অবাধ্য বালক জলহীন দাহন বেলায়।
শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪
আল কোরআন : পরিবর্তনের চালিকা শক্তি
ডঃ মাগদি আল হিলালি
অনুবাদ : মুহাম্মদ আবুল হুসাইন
'রমাযান মাস- যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে; লোকেদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।' -[আল বাকারা : ১৮৫]
পবিত্র কোরআনকে যারা বাস্তবিকই হেদায়াতগ্রন্থ এবং আত্মশুদ্ধির উপায় হিসেবে গ্রহণ করে তাদের জীবনে আল কোরআন বিস্ময়কর পরিবর্তন সাধন করে থাকে। এ পরিবর্তন হয় বিরাট এবং মৌলিক। কোরআন তাদের চরিত্রের পুনর্গঠন করে এবং তাদেরকে নতুন ছাঁচে, নতুন রূপে গড়ে তোলে, যে রূপকে আল্লাহ খুবই পছন্দ করে থাকেন। কোরআনের এই প্রভাব সম্পর্কে কারো মনে যদি কোন সন্দেহ থেকে থাকে, তাহলে তিনি মহানবীর সাহাবীদের জীবনের দিকেই তাকিয়ে দেখতে পারেন যে তাদের জীবনে কী বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের জীবন ছিল দারুন দুর্বিষহ এবং ঘোর অন্ধকার ও অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত। কিন্তু কোরআনের স্পর্শ তাদের চরিত্রে কী পরিবর্তনটাই না ঘটিয়ে দিল! মূলত এর মাধ্যমে কোরআনের পরিবর্তন ও পুনর্গঠন ক্ষমতারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কোরআনের কারণেই আরবের গরীব, গুরুত্বহীন, নগ্নপদের মরুচারী লোকগুলো নতুন এক আত্মিক-শক্তিতে জেগে উঠল, নতুন ছাঁচে ও নতুন রূপে গড়ে উঠল। তাদের জীবনের দৃষ্টি ও কামনা-বাসনাই বদলে গেল এবং তাদের জীবনবোধ এক উন্নত ও মহান লক্ষপাণে পৌঁছুতে সক্ষম হল। তাদের মন-মানসিকতা ও তাদের হৃদয়গুলো এত উন্নত হল যে, তা যেন আল্লাহর আরশকে স্পর্শ করল। মোটকথা কোরআনের স্পর্শে আরবের বর্বর ও ইতর লোকগুলো সোনার মানুষে পরিণত হল এবং এর ফলে আল্লাহর অঙ্গীকারও সত্যে পরিণত হওয়া সম্ভব হল। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে।’-[আর রা’দ : ১১] এই বিরাট নৈতিক বিপ্লবের কারণেই অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই আরবের ঐ মুরুভূমি থেকে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটল, যারা ঐ সময়ের শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর অহংকার ধুলায় মিশিয়ে দিতে সক্ষম হল এবং তাদের কাছ থেকে পৃথিবীর নেতৃত্ব নিয়ে নিল।
এই নাটকীয় পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হল? সম্ভব হল এ কারণেই যে আল কোরআন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মাধ্যমে যথাযথভাবে উপস্থাপিত হতে পেরেছিল এবং এবং নবীর নেতৃত্বে তার সাথীরা কোরআনের আহবানে যথাযথভাবে সাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এত বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল, কারণ আরবের লোকেরা কোরআনকে জানতে পেরেছিলেন, উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ কারণে তারা কোরআনকে যথার্থভাবে মর্যাদা দিতে পেরেছিলেন, সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। আর রাসূলকে তারা পেয়েছিলেন কোরআনেরই বাস্তব মডেল বা নমুনা হিসেবে।
আল্লাহর রাসূল তাঁর জীবনে কোরআনকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, কোরআনের চেতনাতেই তিনি উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি তাই অনুমোদন করেছেন, যার অনুমোদন কোরআন তাঁকে দিয়েছে এবং কোরআন যা নিষেধ করেছে তিনি তাই নিষেধ করতেন। কাজেই মা আয়েশা যখন নবীজির প্রসঙ্গে বলেন যে, তিনি ছিলেন পৃথিবীর বুকে জীবন্ত কোরআন, তখন তাতে অতিশয়োক্তি বা বিস্ময়কর বলে কিছু থাকে না।
আল্লাহর রাসূল কোরআন তেলাওয়াত করতেন ধীর-স্থির ভাবে এবং স্পষ্ট করে। একবার রাতে নামাজ পড়ার সময় তিনি এই আয়াতটি একাধিক বার পড়েন : ‘(হে আল্লাহ) তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দিতে চাও, তাহলে তারা তো তোমারই বান্দা; আর যদি তাদেরকে ক্ষমা কর, তাহলে তুমি তো মহান এবং জ্ঞানী।’-[আল মায়িদা : ১১৮]
পবিত্র কোরআন মহানবীর জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি বলতেন সূরা হুদ এবং এরূপ অন্যান সূরাগুলো তার অন্তরে অত্যন্ত ভয় জাগ্রত করে। কারণ এ সূরা গুলোতে বিচার দিবসের ভয়াবহ দৃশ্য এবং পূর্ববর্তী নাফরমান ও অভিশপ্ত জাতিসমূহের ধ্বংস এবং তাদের ভয়াবহ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব সূরা তেলাওয়াত করার সময় তিনি এতটা প্রভাবিত হতেন যে, তাঁর চেহারা ও শরীরেও ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠতো।
সাহাবীগণ মহানবীর পদাংক অনুসরণ করে চলতেন। তাঁরাও মহানবীর মত কোরআন মজিদের মাধুর্যের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছিলেন এবং এর সাথে জীবনের গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আববাদ ইবনে বিশর-এর একটি ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। একবার যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সঃ) হযরত আববাদ এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে রাতের বেলা কাফেলা পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োগ করলেন। প্রথম পালায় আববাদ পাহারায় নিযুক্ত হলেন এবং আম্মার ঘুমাতে লাগলেন। এক পর্যায়ে স্থানটিকে আববাদের কাছে নিরাপদ মনে হল এবং সে কারণে তিনি তার সময় কাটানোর জন্য নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। সে সময় একজন মুশরিক কিন্তু কাফেলাটিকে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে সুযোগ পেয়ে নামাজে দাঁড়ানো হযরত আববাদকে লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ করল। কিন্তু হযরত আববাদ তাঁর শরীরের বাইরেই তীরটি ধরে ফেলেন এবং যথারীতি নামাজ পড়তে লাগলেন। মুশরিকটি আরেকটি তীর নিক্ষেপ করল। আববাদ এটিও ধরে ফেলেন এবং নামাজ অব্যাহত রাখলেন। মুশরিকটি যখন তৃতীয় তীরটি নিক্ষেপ করে সে মুহূর্তে আম্মার সজাগ হয়ে তাকে ঘায়েল করেন এবং আববাদ যথারীতি রুকু ও সিজদা শেষ করেন। আম্মার যখন আববাদকে জিজ্ঞেস করলেন যে প্রথম যখন তিনি আক্রান্ত হন তখন তিনি আম্মারকে কেন জাগালেন না, তখন আম্মার বলেন, ‘আমি একটি সূরা তেলাওয়াত করছিলাম এবং সেটির তেলাওয়াত শেষ না করে থামতে চাইছিলাম না। কিন্তু সে (মুশরিকটি) যখন আমাকে তীর নিক্ষেপ করতেই থাকলো, তখন আমি আপনাকে জাগালাম। আল্লাহর কসম, আমার যদি এ ভয় না থাকতো যে, আল্লাহর নবী আমাকে যে দায়িত্বে নিয়োগ করেছেন তা ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তাহলে সূরাটি শেষ না করা পর্যন্ত কিংবা সে আমাকে শেষ না করা পর্যন্ত আমি তেলাওয়াত থামাতাম না।’-[আবু দাউদ শরীফ]
উপরের দৃষ্টান্তটি থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর নবী এবং তাঁর সাহাবীগণ কোরআনকে শুধু না বুঝে তেলাওয়াত (lip service) করেননি। আসলে কোরআনের আসল মূল্য, তাৎপর্য ও গুরুত্ব তো কেবল তখনই উপলব্ধি করা সম্ভব হবে যখন কোরআনের কথাগুলো জানা ও বুঝা সম্ভব হবে এবং তখনই কোরআন দ্বারা পাঠকের চরিত্রে কার্যকর পরিবর্তন সম্ভব হবে। কোরআন তো চায় পাঠকের হৃদয়ে বিরাজ করতে, তার চিন্তার জগতে ঝড় তুলতে এবং তার চেতনার পুনর্গঠন করতে। কোরআন চায় জীবন ও জগৎ সম্পর্কে প্রচলিত বদ্ধমূল ও ভুল ধারণাগুলোর অপনোদন করতে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও আধ্যাত্মিকতার সঠিক পথ বলে দিতে, কিন্তু কোরআনের অর্থহীন তেলাওয়াতের মাধ্যমে এবং কোরআনের কথাগুলো জানার চেষ্টা না করার মাধ্যমে কি তা সম্ভব? লোকেরা যখন কোরআনের বক্তব্য জানতে ও বুঝতে পারবে তখন তারা যথাযথভাবে আল্লাহর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভেও সমর্থ হবে। কিন্তু তা না করে চিন্তামুক্ত তেলাওয়াতের মাধ্যমে একই ফল লাভ সম্ভব নয়। এমনকি কেউ যদি কোরআনের অর্থ জানার চেষ্টা না করে পুরো কোরআন হাজার বারও তেলাওয়াত করে তাহলেও তার দ্বারা কোরআনের শিক্ষা হাসিল করা সম্ভব হবে না।
মহানবীর সাহাবীগণ এ বিষয়টি বার বার স্পষ্ট করে বলেছেন। একবার মা আয়েশা কিছু লোকের কথা জানতে পারলেন যারা এক রাতে ২/৩ বার করে কোরআন খতম করত। তিনি তাদের ব্যাপারে হুশিয়ারী করে বলেন, ‘তারা কোরআন পড়ে বলে মনে করে কিন্তু আসলে তাদের কিছুই পড়া হয় না।’ এ প্রসঙ্গে তিনি মহানবীর কোরআন পড়ার পদ্ধতি বর্ণনা করে বলেন, তিনি সারা রাতে নামাজে শুধুমাত্র সূরা আল বাকারা, আল ইমরান এবং আন নিসা পড়তেন। তিনি আরো বলেন, মহানবী (সঃ) যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন তখন সুসংবাদের আয়াত পড়ার সাথে সাথে আল্লাহর দয়া ও রহমত কামনা করতেন এবং ভয়সূচক আয়াত তেলাওয়াত করলে সাথে সাথে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে মুনাজাত করতেন।
একবার আবু জামরা ইবনে আববাসকে বলেন, ‘আমি খুব দ্রুত কোরআন পড়ি এবং তিন দিনে এক খতম দেই। জবাবে ইবনে আববাস বলেন, আমি এ রকম করি না। আমি বুঝে-শুনে এবং সতর্কতার সাথে তেলাওয়াত করে সারা রাতে শুধু মাত্র সূরা বাকারা তেলাওয়াত করা পছন্দ করি।’
আল আগরি• তার কোরআনের বাহকদের নৈতিকতা বিষয়ক গ্রন্থ বলেছেন, বুঝে-শুনে এবং যথার্থ চিন্তা-ভাবনা করে কোরআনের কিছু অংশ পড়া না বুঝে এবং চিন্তা-ভাবনা না করে অনেকখানি তেলাওয়াত করার চেয়ে উত্তম। আল কোরআনের বহু জায়গায়, মহানবীর সুন্নায় এবং বিখ্যাত মুসলিম মনীষীদের বহু উক্তিতে এ বিষয়টির উপর জোর দেয়া হয়েছে। একবার মুজাহিদকে জিজ্ঞেস করা হল ঐ দু ব্যক্তির মধ্যে কার নামাজ উত্তম যাদের দুজনই একই ভাবে রুকু-সিজদা করে, কিন্তু প্রথম জন তার নামাজে শুধু সূরা বাকারা তেলাওয়াত করে অথচ ঐ একই সময়ে অন্যজন সূরা বাকারা এবং আল ইমরান তেলাওয়াত করে? জবাবে তিনি বললেন, যে জন শুধু সূরা বাকারা তেলাওয়াত করে সেই উত্তম। তিনি তার রায়ের পক্ষে নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাতে বলা হয়েছে : ‘‘এটি সেই কোরআন, যা আমি তোমার প্রতি অল্প অল্প করে নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের কাছে এটি ধীর-স্থির ভাবে তেলাওয়াত করে শোনাতে পার।’-[আল ইসরা : ১০৬]